মূল্যস্ফীতি ও নানা কড়াকড়িতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে। গত আগস্টে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৮ কোটি টাকার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এ ছাড়া এই সংখ্যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪৯ গুণ এবং আগের মাসের (জুলাই ২০২২) চেয়ে ৪৮ গুণ কম।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪০১ কোটি টাকার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ গুণ কম। এ ছাড়া গত আগস্টে যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার প্রায় সমপরিমাণ ভাঙাও পড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন বেড়ে যায়। এর প্রভাবে বেড়ে যায় মানুষের ভোগব্যয়। খরচের সঙ্গে পেরে না ওঠায় অনেক মানুষ সঞ্চয়পত্র ভাঙতে শুরু করেন। মেয়াদপূর্তির আগেও অনেকে সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। কেউ আবার মেয়াদপূর্তিতেও পুনর্বিনিয়োগ না করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এর মধ্যেও যাদের কিছু সঞ্চয় আছে, তারাও কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্রে তা বিনিয়োগে আগ্রহ পাচ্ছেন না। ব্যাংকেও আমানত আসা কমে গেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, সাধারণত সঞ্চয় করেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। মূল্যস্ফীতির গড় হিসাব সরকারিভাবে যা প্রকাশ করা হচ্ছে, তার চেয়ে নিত্যপণ্য কেনার খরচ বাস্তবে অনেক বেশি। ফলে সংসার চালাতে সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছেন তারা। তিনি আরও বলেন, বাজার অর্থনীতিতে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আরওআই) বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা যদি বিভিন্ন বাজারে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট দিতে না পারি, তাহলে উন্নতি করা কিন্তু কঠিন হবে। কারণ যারা সঞ্চয়কারী, তারা যে শুধু সঞ্চয় দেশে রাখবে তা নয়, তারা বিদেশেও সঞ্চয় করতে পারে। কাজেই আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হবে। নইলে টাকা পাচার হয়ে যাবে। তাই সঞ্চয়কে বাজারে আকর্ষণীয় রাখতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বলেন, এমনিতেই দুই বছরের করোনা মহামারীর কারণে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারও বেতন কমেছে। এখন মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনায় সীমা আরোপসহ বিভিন্ন কড়াকড়ি আরোপের কারণেও বিক্রি কমে গেছে।
প্রতি অর্থবছরের বাজেটে নিট বিক্রি হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের প্রতিবেদন বলছে, সর্বশেষ আগস্ট মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার ৫১৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকার। একই সময়ে ভাঙানো হয়েছে ৭ হাজার ৫১১ কোটি ৬১ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। ফলে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ কোটি ৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল বা আসল পরিশোধের পর যা থাকে তা নিট বিক্রি হিসেবে পরিগণিত হয়। এই নিট বিক্রিকে সরকারের ঋণ বলা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরের আগস্টে রেকর্ড ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। আর গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে সেই বিক্রিতে ব্যাপক ধস নেমেছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট বিক্রি হয় ৩৯৩ কোটি টাকা। আর গত আগস্টে তা ব্যাপকভাবে কমে মাত্র ৮ কোটিতে নেমে এসেছে।
নিম্নমধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলক বেশি মুনাফা (সুদ) দেয় সরকার। তবে সম্প্রতি সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা কড়াকড়ি আরোপের পর বিক্রি ক্রমশ কমে যাচ্ছে। যেমন গত অর্থবছরও সঞ্চয়পত্র থেকে তুলনামূলক কম ঋণ পেয়েছে সরকার। পুরো অর্থবছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট বিক্রি হয় ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। অথচ করোনার পরও ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এটি তার আগের অর্থবছরে ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এতে সরকারের ঋণের বোঝা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে ২ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি। এরপর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পরিবার সঞ্চয়পত্র-এই তিনটি স্কিমের বিপরীতে সমন্বিত বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা এবং যৌথ নামে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। আগে একক নামে সর্বোচ্চ এক কোটি ৫৫ লাখ এবং যৌথ নামে দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারতেন গ্রাহকরা। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। আর সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে আয়কর রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব কারণেও অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার পর ব্যাংকে আমানত আসাও কমে গেছে। গত অর্থবছরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমানত কমার পর চলতি অর্থবছরেও তা নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে তার আগের মাসের চেয়ে দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানত কমেছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে আমানত কমেছিল সাড়ে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। অথচ করোনা মহামারীর অর্থবছরে (২০২০-২১) ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছিল প্রায় সোয়া ৫৩ হাজার কোটি টাকা।