ডা. এস.জামান পলাশ
জ্বর কোনো রোগ নয় রোগের লণ মাত্র। কেউ জ্বরকে গুরুত্বই দেন না, কেউ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন শুরু করেন। দুটোই বিপজ্জনক। কখনো জ্বরে ভোগেননি এমন লোক পাওয়া মুশকিল। তবে জ্বর কোনো অসুখ নয় অসুখের লণ মাত্র। আবার গা গরম হওয়া মানেই কিন্তু জ্বর নয়। সংজ্ঞানুসারে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী মানদণ্ড স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গিয়ে যদি শরীরের তাপমাত্রা ৩৬.৫ সেন্টিগ্রেড-৩৭.৫ সেন্টিগ্রেড (৯৮-১০০ ফারেনহাইট) থেকে বেড়ে যায়, তবেই জ্বর বলে ধরে নেওয়া হয়। সাধারণত শরীরের তাপমাত্রা ৯৮.৪ বা ৯৮.৬ ফারেনহাইট থাকে। ১ ফারেনহাইট কম বা বেশিও হতে পারে। আবার দিনের বিভিন্ন সময়েও তাপমাত্রা ১ ফারেনহাইট কমবেশি হতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তাপমাত্রা ১০০.৪ ফারেনহাইটের বেশি না হলে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই এবং একে স্বল্পমাত্রার জ্বর বা লো গ্রেড ফিভার বলে। জ্বরকে দেহের প্রোটেকটিভ মেকানিজম বা প্রতিরাকারী প্রক্রিয়াও বলে। কারণ কিছু জীবাণু যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস উচ্চ তাপমাত্রায় জীবনধারণ করতে পারে না। জ্বর কখনো একা আসে না, কখনো সঙ্গে আনে কাশি, গলা ব্যথা, দুর্বলতা, গা ব্যথা, কাঁপুনি, বমি ভাব ও খাবারে অরুচি ইত্যাদি।
একজন সুস্থ নারী বা পুরুষের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হলো
* মুখে থার্মোমিটার দিয়ে মাপলে ৯২-১০০ ফারেনহাইট
* রেক্টাম বা পায়ূপথে থার্মোমিটার দিয়ে মাপলে ৯৪-১০০ ফারেনহাইট
* হাতের নিচে থার্মোমিটার দিয়ে মাপলে ৯৬-৯৯ ফারেনহাইট
বিভিন্ন ধরনের জ্বর
* চলমান জ্বর : এ েেত্র দিনব্যাপী জ্বর থাকে ও সারা দিনে তাপমাত্রার তারতম্য ১ ফারেনহাইটের বেশি হয় না। (জ্বরের ওষুধ খাওয়ালে অবশ্য কমবেশি হবে) এ ধরনের জ্বরের কারণ লোবার নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, প্রস্রাবের ইনফেকশন ইত্যাদি।
* নির্দিষ্ট বিরতির পর জ্বর : এ েেত্র দিনে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর জ্বর আসে এবং মধ্যবর্তী সময় তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে। এ ধরনের জ্বরের কারণ ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, সেপটিসেমিয়া (রক্তে ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন) ইত্যাদি।
* রেমিটেন্ট ফিভার : এ েেত্র সারা দিনই জ্বর থাকে, তবে তাপমাত্রার ওঠানামা ১ ফারেনহাইটের বেশি হয়। জ্বর কখনোই ছেড়ে যায় না এবং তাপমাত্রাও একেবারে স্বাভাবিক হয় না। এ ধরনের জ্বরের কারণ ইনফেকটিভ এনডোকার্ডাইটিস বা হার্টের এক ধরনের ইনফামেশন।
* পল অ্যাবস্টেন ফিভার : এটি একটি বিশেষ ধরনের জ্বর, যেখানে এক সপ্তাহ অনেক জ্বর থাকার পর পরবর্তী সপ্তাহে জ্বর একেবারেই থাকে না। আবার পরের সপ্তাহে জ্বর আসে। এ ধরনের জ্বরের কারণ হজকিন্স লিম্ফোমা।
* পারসিসট্যান্ট ফিভার বা ক্রমাগত জ্বর : ব্যাখ্যাতীত কারণে ক্রমাগত জ্বর, যা অজ্ঞাত কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়া হিসেবে চিকিৎসকরা শনাক্ত করেন। তবে কখনো কখনো জ্বর ছাড়াও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। একে হাইপারথারমিয়া বলে। যেমনথহিটস্ট্রোক হলে ও কিছু ওষুধ খেলে।
* অতিরিক্ত জ্বর : তাপমাত্রা ১০৬ ফারেনহাইটের চেয়ে বেশি হলে এটি একটি মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি, অতি দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অনেক েেত্রই রোগী মারা যেতে পারে। এ ধরনের জ্বরের কারণ মস্তিষ্কে রক্তরণ, সেপসিস, থাইরয়েড স্ট্রম, কাওয়াসাকি সিনড্রোম ইত্যাদি।
জ্বরের কারণগুলো
* ইনফেকশনের কারণেথইনফুয়েঞ্জা, এনকেফালাইটিস, ম্যালেরিয়া, মেনিনজাইটিস, ইনফেকশাস মনোনিউকিওসিস গ্যাস্ট্র্রোএন্টেরাইটিস।
* ইনফামেশনের কারণেথফোঁড়া, অ্যাবসেস হলে।
* টিস্যু তিগ্রস্ত হলে, যেমনথঅপারেশনের পর, এঙি্ডেেন্টর পর, মস্তিষ্কে রক্তরণ, হিমোলাইটিক ডিজিজ বা রক্তকণিকা ভাঙার অসুখ, কেমোথেরাপি নিলে।
* রক্ত দেওয়ার পর যদি দাতা ও গ্রহীতার রক্তের ক্রস ম্যাচিং বা সঠিক সমন্বয় না হয়।
* ক্যান্সারথলিউকেমিয়া, লিম্ফোমা ইত্যাদি হলে।
* পালমোনারি এমবোলিজম হলে।
* ডিপ ভেইন থ্রম্বসিস হলে।
* কখনো কিছু মেটাবোলিক অসুস্থতায় গাউট হলে।
জ্বর হলে কী হয়?
জ্বর শরীরের কোনো অসুবিধার জন্যই হয়। তবে এটি প্রতিরাকারী প্রক্রিয়া। কারণ জ্বর হলেথ
* উচ্চ তাপমাত্রায় রক্তের শ্বেতকণিকা দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং শরীরে অনুপ্রবিষ্ট জীবাণু ধ্বংস করে।
* উচ্চ তাপমাত্রায় ফ্যাগোসাইটোসিস বা তিকর জীবাণু খেয়ে ফেলার স্বাভাবিক দৈহিক প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়।
* রোগ প্রতিরোধকারী টি সেলের বিস্তার বেড়ে যায়, যা দেহকে প্রতিরা দেয়।
* উচ্চ তাপমাত্রায় জীবাণু ও জীবাণু থেকে নিঃসৃত তিকর পদার্থকে অকার্যকর করে।
জ্বর সম্পর্কে ভুল ধারণা
* অনেকেই জ্বরের সময় কিছু খান না। এতে শরীর দুর্বল হয়ে জীবাণুর বংশবিস্তার দ্রুততর হয়।
* জ্বরের সময় অনেকে পানি ও জুস খান না এই মনে করে যে এতে ঠাণ্ডা আরো বেড়ে যাবেথকিন্তু এটি ঠিক নয়। জ্বরের সময় প্রচুর পানি, ডাবের পানি ও ফলের রস খেতে হবে, যেন শরীর পানিশূন্যতার শিকার না হয়।
* জ্বরের সময় অনেকে মাথায় পানি ঢালেন। কিন্তু অতিরিক্ত পানি মাথায় ঢালার প্রয়োজন নেই। মাথা ধুলে দ্রুত শুকিয়ে ফেলুন। ভেজা চুল নিউমোনিয়া বা অন্যান্য ফুসফুসজনিত ইনফেকশনের কারণ হতে পারে।
* ঠাণ্ডা বা বরফ শীতল পানি দিয়ে অনেকে গা স্পঞ্জ করেন। এটিও ঠিক নয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দিয়ে গা স্পঞ্জ করে তোয়ালে দিয়ে মুছে শুকিয়ে ফেলতে হবে।
* অনেকে জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে চান না। কিন্তু জ্বর ১০২০-এর বেশি হলে অবশ্যই জ্বরের ওষুধ খাওয়া উচিত। বিশেষ করে শিশুদের। কারণ অন্যথায় তাপমাত্রা ১০৫০ ফারেনহাইট উঠে গেলে মস্তিষ্ক তিগ্রস্ত হতে পারে। খিঁচুনি হতে পারে।
জ্বর হলেই কি অ্যান্টিবায়োটিক?
প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধের দোকানে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়, রোগীরাও অ্যান্টিবায়োটিক খেতে শুরু করে দেন জ্বর আসার সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু অধিকাংশ জ্বরের েেত্রই অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নেই-ই, বরং কোনো কোনো েেত্র হতে পারে তির কারণ।
* অ্যান্টিবায়োটিক হলো সেইসব ওষুধ, যা ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে বা বিস্তার রোধ করে। এটি জ্বর কমায় না। যদি জ্বর ভাইরাসঘটিত হয়, সে েেত্র অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজন নেই, কাজও নেই। শ্বাসনালির সমস্যা বা আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন যেমনথফু, কমন কোল্ড বা সর্দিজ্বর, গলা ব্যথা ইত্যাদি অধিকাংশ েেত্রই ভাইরাসঘটিত ও ৫-৭ দিনের মধ্যে আপনা থেকেই ভালো হয়ে যায়।
* কোনো সুনির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনোসিসে পৌঁছার আগেই অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করে দিলে প্রকৃত রোগটি অনেক সময় ধরা পড়ে না ও সুচিকিৎসা পাওয়া অসম্ভব হয়ে যায়।
* জ্বর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিলে বাচ্চাদের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ মতা তৈরি হওয়ার সুযোগও হয় না। তাই অন্তত দুই দিন না গেলে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা উচিত নয়। মনে রাখবেন, মেনিনজাইটিস বা সেপটিসেমিয়া ব্যতীত অন্যান্য েেত্র দেরি করে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করলে কোনো অসুবিধা নেই।
* যদি জ্বরের সঙ্গে পেট খারাপ থাকে, তবে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়ে যেকোনো অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করলে ইনফেকশন আরো বেড়ে যায়। সালমোনেলা নামক জীবাণুর েেত্র অকার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে রোগী ক্রনিক ক্যারিয়ার বা বাহকে পরিণত হয়। কখনো যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে রোগী মারাত্মক অন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
* কোনো কারণ ছাড়াই ব্রড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে শরীরে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স হয়। তাই আন্দাজে অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়ে পরীা করে নিশ্চিত হয়ে দিতে হবে।
* রোগীরা অনেক সময় ভাবেন, দামি অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই দ্রুত রোগ সারবে। দোকানদার বা হাতুড়ে ডাক্তাররা এ সুযোগে প্রচুর দামি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। কিন্তু মনে রাখবেন, বেশির ভাগ জ্বরে যদি অ্যান্টিবায়োটিক লাগে তা কম দামের পেনিসিলিন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকই যথেষ্ট।
কখন অ্যান্টিবায়োটিক খেতেই হয়?
* যাঁদের রোগ প্রতিরোধ মতা কম বা যারা ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোমে আক্রান্ত।
* যাঁরা ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট (যেমন ক্যান্সারের ওষুধ, কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করার পর যে ধরনের ওষুধ খেতে হয়) ওষুধ খান।
* কেমোথেরাপি নিলে।
* যাঁদের কোনো কারণে স্পিন বা পিহা ফেলে দেওয়া হয়েছে।
* বাতজ্বরের রোগী, এ েেত্র অ্যান্টিবায়োটিক না খেলে হার্টের ভাল্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
* জ্বর যদি যক্ষ্মা বা টিবির কারণে হয়থমনে রাখবেন, অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করলে দু-এক দিনের মধ্যে অনেক সময়ই জ্বর ভালো হয়ে যায়। কিন্তু জ্বর চলে গেলেই ওষুধ বন্ধ করা যাবে না।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় এটাও বিপদের কারণ হতে পারে।
কখন জ্বর ভয়ের কারণ
* জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হলে
* জ্বরের সঙ্গে ঘাড় শক্ত হয়ে গেলে।
* গায়ে লাল লাল ছোপ বা র্যাশ থাকলে ।
* শরীরের অন্যান্য গ্যান্ড বা লিম্ফ নোড ফুলে গেলে।
* শ্বাসকষ্ট ও কাশি থাকলে।
* মাথায় আঘাতের পর বমি, চোখে ঝাপসা দেখার পাশাপাশি জ্বর থাকলে।
* বারবার জ্বর এলে ও চিকিৎসায় ভালো না হলে।
* জ্বর ও গিঁটে ব্যথা থাকলে। এ েেত্র বাতজ্বর হতে পারে।
* জ্বর ও খুশখুশে কাশি তিন সপ্তাহের বেশি থাকলেথএ েেত্র যক্ষ্মা হতে পারে।
* হার্টের ভাল্বের অপারেশনের পর ক্রমাগত জ্বর থাকলে।
* কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চলমান অবস্থায় জ্বর এলে।
* জ্বরের সঙ্গে পেট ফুলতে থাকলে।
* ক্যাথেটার করা রোগীর জ্বর এলে।
* অপারেশনের পর ঘন ঘন জ্বর এলে।
* নবজাত শিশুর জ্বর থাকলে।
* কিডনি ট্রান্সপ্যান্ট করা রোগীর জ্বর এলে।
মনে রাখবেন, জ্বর বেশি মানেই রোগ বেশি এবং জ্বর কম মানে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেইথএটা ঠিক নয়। কারণ অনেক সময় অনেক সাধারণ অসুখে অনেক জ্বর থাকে, আবার কোনো কোনো সময় মারাত্মক অসুখেও হালকা জ্বর থাকে।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাঃ- জ্বর আসার সময়.লন ও রোগীর শারীরিক ও মানষিক অবস্থা বিবেচনা করে যত জটিল এবং পুরাতন জ্বর হউকনা কেন হোমিও চিকিৎসায় জ্বর ভালো করা সম্ভব।
============================================
ডাঃ এস.জামান পলাশ
জামান হোমিও হল
01711-943435
ওয়েব সাইট –www.zamanhomeo.com
ব্লগ–https://zamanhomeo.com/blog