সরকারের মেয়াদ আর এক বছর বাকি থাকতে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে শপথ নিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছয় নেতা ও সরকারের শরিক দল জাসদের একজন।
এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সংসদের হুইপের দায়িত্বে থাকা মুজিবুল হক এবং দুটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করা এ এইচ মাহমুদ আলী ও মোস্তফা ফারুখ মোহাম্মদ মন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন।
এছাড়া রাজশাহীর সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী এবং ঝিনাইদহের সাংসদ আব্দুল হাই প্রতিমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার বিকালে বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তাদের এই শপথের মধ্য দিয়ে বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা অর্ধশতক পূর্ণ হল।
২২ মিনিটের শপথ অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন থেকে তিলাওয়াতের পর নতুন মন্ত্রীদের শপথ নেয়ার অনুরোধ জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। শপথ বাক্য পড়ার পর তারা একে একে শপথনামায় সই করেন।
এরপর নতুন মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে এসে তাদের সালাম জানান। আর মুজিবুল হক সালাম করেন পা ছুঁয়ে।
রাষ্ট্রপতি এরপর দুই প্রতিমন্ত্রীকে শপথ পড়ান। তারা দুজনেই শপথ নেয়ার পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করেন।
অন্যদের মধ্যে জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাসান মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, মশিউর রহমান ও গওহর রিজভীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
শপথের পর শেখ হাসিনা ও জিল্লুর রহমান মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর সবাই যোগ দেন চা চক্রে।
দুজনের ‘না’, নতুন দুজন ‘যোগ’
বুধবার রাতে সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার জন্য তোফায়েল আহমেদ, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ও মুজিবুল হককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ পান ওমর ফারুক চৌধুরী ও আব্দুল হাই। সে অনুযায়ী বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানেরও প্রস্তুতি নেয়া হয়।
কিন্তু সকালে পলিট ব্যুরোর সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মন্ত্রিসভায় যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত জানান। সরকারকে একই সিদ্ধান্ত জানান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ।
তারা ‘না’ বলার পর দিনাজপুরের সাংসদ এ এইচ মাহমুদ আলী ও যশোরের মোস্তফা ফারুখ মোহাম্মদকে মন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয় বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা।
‘প্রতিক্রিয়া নেই’
শপথ অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ বা রদবদল সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি নিয়মিত কাজ।
আমন্ত্রণ পেয়েও তোফায়েল ও মেননের না আসার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সাত জন শপথ নেয়ার কথা ছিল, সাতজন নিয়েছে।”
কে কোন দায়িত্ব পাচ্ছে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “রোববার অফিস খুলবে, তার আগেই আপনারা জেনে যাবেন।”
নতুনদের কৃতজ্ঞতা-প্রত্যয়
শপথের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেন, “সরকারের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি সফল হব।”
মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “সরকারের শেষ সময়ে এসে মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেও চ্যালেঞ্জ কঠিন হবে না, যদিও দায়িত্বটা গুরু।”
“প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর যে আস্থা রেখেছেন তার প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করব”, বলেন এই সাবেক সচিব।
মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়ায় মুজিবুল হক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং নিজের নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লার ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
দিনাজপুরের সাংসদ মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সাংসদ হিসাবে দেশের উন্নয়নে আগে থেকেই কাজ করে চলেছি। এখন মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ায় কাজের সুযোগ আরো বাড়বে।”
মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়ে ‘আনন্দিত’ হয়েছেন জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই বলেন, “যে সময়ের জন্য এই দায়িত্ব পেয়েছি, সেই পর্যন্ত দেশের কাজ করে যেতে চাই।”
চার দফা রদবদল
নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান সরকার গঠন করেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। এরপর এ নিয়ে চতুর্থ দফা তার মন্ত্রিসভায় রদবদল হলো।
সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে মন্ত্রিসভায় যোগ হন রাজনীতির দুই পুরনো মুখ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ওবায়দুল কাদের। তবে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল জলিলের মতো রথী-মহারথীদের ঠাঁই হয়নি মন্ত্রিসভার আগের সম্প্রসারণে।
শেখ হাসিনার গত সরকারের শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল জরুরি অবস্থার সময় সুরঞ্জিতের মতো সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি পেয়ে দলীয় কর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েন। এবার তিনি মন্ত্রী হওয়ার ডাক পেয়েও তা নিলেন না।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বনানীর বাসায় তিনি বলেন, “আমি মানসিক, সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে এখন মন্ত্রিসভার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত নই।”
নতুন করে মন্ত্রী হওয়া মহীউদ্দীন খান আলমগীর গত আওয়ামী লীগ সরকারে টেকনোক্র্যাট হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। এই সাবেক সচিবকে জরুরি অবস্থার সময় কারাভোগও করতে হয়েছে।
আরেক নতুন মন্ত্রী কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সংসদ সদস্য মুজিবুল হক সংসদে হুইপের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
মহাজোট সরকারের বর্তমান মন্ত্রিসভায় আগেই স্থান পেয়েছিলেন শরিক দলগুলোর দুই নেতা জাতীয় পার্টির জি এম কাদের ও সাম্যবাদী দলের দীলিপ বড়–য়া। এবার তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন জাসদ সভাপতি ইনু, যিনি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
তোফায়েল-মেননের বদলে মন্ত্রিসভায় আসা এ এইচ মাহমুদ আলী ও মোস্তফা ফারুখ মোহাম্মদ দুজনেই সাবেক কূটনীতিক।
দিনাজপুর-৪ আসনের সাংসদ এ এইচ মাহমুদ আলী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর যশোর-২ আসনের সাংসদ মোস্তফা ফারুখ মোহাম্মদ আছেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসাবে।
তারা দুজনেই ১৯৬০ এর দশকে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো সংসদে আসেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত হয়েছিলেন মাহমুদ আলী, যিনি ১৯৯০ এর ডিসেম্বরে অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালে সহকর্মীদের নিয়ে এইচ এম এরশাদ সরকারের পদত্যাগ দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে ২০০১ সালে অবসরে যান মাহমুদ আলী। এর আগে জার্মানি ও ভুটানেও রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করা মোস্তফা ফারুখ ভারত, রাশিয়া, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রতিমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেয়া ওমর ফারুক রাজশাহী এবং আব্দুল হাই ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
বর্তমান সরকারে অপর মন্ত্রীরা হলেন- মতিয়া চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, এ কে খন্দকার, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, শফিক আহমেদ, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, সাহারা খাতুন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ওবায়দুল কাদের, খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, রেজাউল করিম হীরা, আবুল কালাম আজাদ, আ ফ ম রুহুল হক, দীপু মনি, আফসারুল আমীন, আব্দুর রাজ্জাক, এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, নূরুল ইসলাম নাহিদ, আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, ফারুক খান, রমেশ চন্দ্র সেন, শাজাহান খান, জি এম কাদের, হাছান মাহমুদ ও দিলীপ বড়ুয়া।
প্রতিমন্ত্রীরা হলেন- শামসুল হক টুকু, আব্দুল মান্নান খান, মো. মোতাহার হোসেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মো. কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ এনামুল হক, ডা. মজিবর রহমান ফকির, প্রমোদ মানকিন, মো. শাহজাহান মিয়া, মাহবুবুর রহমান, মুস্তাফিজার রহমান ফিজার, দীপঙ্কর তালুকদার, এ বি তাজুল ইসলাম, মুন্নুজান সুফিয়ান, আহাদ আলী সরকার, শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ইয়াফেস ওসমান।
প্রথম দফায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া সৈয়দ আবুল হোসেন এবং প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া তানজিম আহমদ (সোহেল তাজ) পদত্যাগ করেন। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত পদত্যাগ করলেও তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে রাখা হয়েছে।