প্রতিনিধি
হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মী বেশ ক�টি ভোট কেন্দ্র দখল করে সিলিং করেছে। একটি কেন্দ্রে সিলিংয়ের ছবি তোলার কারণে দখলকারীরা সাংবাদিকের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়েছে, গুলি করার হুমকি দিয়েছে। দুপুর ১২টায় চাঁদপুর থেকে নির্বাচনের নিউজ কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের একটি দল হাজীগঞ্জ শহরের বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ কেন্দ্রে প্রবেশ করে। এ সময় চাঁদপুর থেকে যাওয়া কনস্টেবল আফসার প্রথমে সাংবাদিকদের ঢুকতে বাধা দেন। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে আপনারা কী করছেন। একটু ভেতরে ঢুকে দেখা গেলো, টিনশেড ঘরের মধ্যে জটলা বাঁধানো একটি সংঘবদ্ধ দল। জানা গেলো তারা হাজীগঞ্জ উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। সামনে গিয়ে দেখা যায়, পোলিং অফিসাররা অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। এ সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী জনৈক ছাত্রনেতাসহ আরো ক�জন আনারস প্রতীকে সিল মারছিলেন। ইল্শেপাড়ের প্রধান সম্পাদক মাহবুবুর রহমান সুমন ছবি তুলতে গেলে ওই নেতারা তাকে মারধর করে ক্যামেরা ছিনতাই করে নিয়ে যায়। সাংবাদিক ক্যামেরা দিতে অস্বীকার করলে ওই ছাত্রনেতা অস্ত্র ঠেকিয়ে তাকে হুমকি দেয়, ক্যামেরা দে, না হয় গুলি করবো। তারা এ সময় সংবাদকর্মীদের কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। মুহূর্তের মধ্যে খবরটি ছড়িয়ে পড়লে চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং বিভিন্ন স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্যরা ছুটে আসেন।
ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা দুঃখ প্রকাশ করে ক্যামেরা ফিরিয়ে দিলেও সিলিং করা ছবিগুলো মুছে ফেলে। উপস্থিত সিনিয়র ক�জন সংবাদকর্মীর সামনে চোখে কালো চশমা দিয়ে থাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী ওই ছাত্রনেতা বলেন, তার একটা ভবিষ্যৎ আছে। তার ছবি তোলার কারণেই তিনি ক্যামেরা নিয়ে গেছেন। চাঁদপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (হেড কোয়ার্টার) শচীন চাকমা ঐ কেন্দ্রে গেলে তারা পালিয়ে যায়। উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে সহকারী পুলিশ সুপার শচীন চাকমা উপজেলা শিক্ষা অফিসার (প্রিজাইডিং অফিসার) আঃ আওয়ালকে দিয়ে সিলিং করা ব্যালটগুলো জব্দ করান। তখন যে বুথে ব্যালট সিলিং হচ্ছিলো সেই বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার রীতিমতো কাঁপছিলেন।
দুপুরে আমিন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়সহ তৎসংলগ্ন কেন্দ্রে গেলে সেখানেও সিলিংয়ের অভিযোগ পাওয়া যায়। ভোটাররা সেই কেন্দ্রে গেলে তাদের টিপসই রেখে বের করে দেয় আওয়ামী লীগ মনোনীত আনারস প্রতীকের প্রার্থী অধ্যাপক আঃ রশিদ মজুমদারের লোকজন। এ সময় এক প্রতিবাদী ভোটার এসে প্রতিবাদ করলে ওই প্রার্থীর লোকজন তাকে মারধর করে। দুপুরের দিকে তারাপাল্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাবালক ৩ জন ভুয়া ভোটার বিল্লাল, পারভেজ, নাজমুল ভোট দিতে গেলে পোলিং অফিসাররা তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। বিকেল ৩টায় ইছাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আনারস প্রতীকের লোকজন অন্যান্য প্রার্থীদের লোকজনকে বের করে দেয়। এ সময় দু� গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হলে বেশ ক�জন আহত হয়। সকাল সোয়া ৯টায় হাজীগঞ্জের গন্ধর্ব্যপুর সপ্রাবি স্কুলে গিয়ে দেখা যায় কেন্দ্র খালি। বুথের ভেতর রাখা ভোট বাক্সগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ওই সময় ৩ হাজার ৫শ� ভোটের মধ্যে ২ হাজার ভোট কাস্ট হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় দেশগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ২ হাজার ৪শ� ৫৪ জন ভোটরের মধ্যে ১ হাজার ৫শ� ভোট কাস্ট হয়। কিন্তু কেন্দ্র ছিলো ফাঁকা। সাড়ে ১১টায় সেন্দ্রা সকরারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ হাজার ৬শ� ৭০ ভোটের মধ্যে ১ হাজার ভোট কাস্ট হয়। দুপুর পৌনে ১২টায় বেলচোঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৬শ� ভোটারদের মধ্যে ২ হাজারের উপর ভোটারের ভোট প্রদান হয়ে যায়। ৮টি বুথে তখন কোনো ভোটারই দেখা যায়নি। স্থানীয় লোকজন সাংবাদিকদের জানান, আপনাদের দেখে অনেকেই পালিয়ে গেছে। কোনো ভোটারকে আনারস মার্কার লোকজন ঢুকতে দেয়নি।
বেলা ১১টায় পশ্চিম রাজারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল হয়ে গেলে সেটির ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এর কিছুক্ষণ পর একই অভিযোগে মেনাপুর ও কালচোঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সাময়িকভাবে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।
সরেজমিন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সময় যে বিষয়টি খুব বেশি চোখে পড়েছে তা হচ্ছে, দোয়াত-কলম প্রতীক সমর্থিত প্রচুর ভোটার কেন্দ্রের কাছে থাকলেও তাদের নেতা-কর্মীরা মাঠে ছিলেন না। হাজীগঞ্জের কৃতী সন্তান, জেলা বিএনপির এক ক্ষমতাধর নেতা বেলা ২টায় ঘুম ঘুম কণ্ঠে সাংবাদিকদের কাছে নির্বাচনী মাঠের পরিস্থিতি জানতে চেয়েছেন। বেশ ক�টি কেন্দ্রে দোয়াত-কলাম প্রতীকের পোলিং এজেন্ট ছিলো না। অধিকাংশ কেন্দ্রে তাদের ব্যাজ পরিহিত কোনো কর্মীও চোখে পড়েনি।
এদিকে কাপ-পিরিচ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. আলমগীর কবির পাটওয়ারীকে নেতা-কর্মী ছাড়া এতিমের মতো অসহায় অবস্থায় বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বেলা আড়াইটায় সাংবাদিক ডেকে তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে মাঠ ত্যাগ করেন।
উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলে দু-চারটি কেন্দ্রে বিএনপি অবস্থান নিতে চাইলেও প্রশাসনিক বাধার কারণে তা� সম্ভব হয়ে উঠেনি। ফলাফল যাই হোক, হাজীগঞ্জবাসীর একটি বৃহৎ অংশ এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনেক বেশি ব্যথিত এবং মর্মাহত। অনেক কেন্দ্রে দখলদাররা সাধারণ ভোটারের কাছ থেকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে তারা নিজেরা সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়েছে।