দিলরুবা সুমী:
বোর্ডের বই ছাড়াও বেসরকারি স্কুলগুলোতে সহায়ক বইয়ের বাড়তি চাপে রয়েছে শিশু শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত তিনটির বাইরে আরও ছয় থেকে দশটি বই প্রায় সব বেসরকারি এমপিওভুক্ত ও কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোতে দেওয়া হয়। অন্যান্য শ্রেণিতে এ সংখ্যা একটু কমে দু’থেকে ছয়টি পর্যন্ত সহায়ক বই দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের বহন করতে কষ্ট হয়, মা-বাবা পেটমোটা ব্যাগ নিয়ে পশে হেঁটে যাচ্ছেন-এমন দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে। এত বই শিশুদের প্রয়োজন, নাকি এর পেছনে পুস্তক ব্যবসায়ীরা সক্রিয়, এ প্রশ্ন অনেক দিনের। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কারিকুলামের বই দেশের সব শিশুকেই সরকার দিচ্ছে বিনামূল্যে। বেসরকারি স্কুলে ভর্তি ও পোশাক বানানোর খরচ তুলনামূলক বেশি। সেখানে অভিভাবকদের বাড়তি বইগুলো বাবদ অতিরিক্ত হাজার, দু’হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়।
বিভিন্ন স্কুলের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের একটি বড় অংশই এসব বাড়তি বইয়ের বিপক্ষে। তাদের মতে, দেশের প্রায় ৬৪ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী বিনামূল্যে সরকার থেকে দেওয়া বোর্ডের বইগুলোই শুধু পড়ছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে তাদের ফল কোনো অংশেই খারাপ নয়। সেখানে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতেই এত বেশি বাড়তি বিষয় পড়ার চাপ কি তাদের প্রাথমিক ভিত মজবুত করার সহায়ক না বিপরীত? সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই পার্থক্য করাইবা কেন-এ প্রশ্ন তাদের।
সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বৈষম্যহীন ও একই মানের করার কথা বলা হয়েছে। সরকার নির্ধারিত বইয়ের বাইরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়তি বিষয় পাঠ্য করতে চাইলে তার জন্য শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের অনুমতি নেওয়ার কথা বলা আছে। ‘প্রথম শিক্ষা আইন-২০১৩’-এর চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণয়ন করবে। বোর্ডের অনুমতি ছাড়া শিক্ষাক্রমে অতিরিক্ত কোনো বিষয় বা পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্ত করলে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলু বলেন, সরকার খসড়া শিক্ষা আইনটি পাস করে তা বাস্তবায়ন করতে পারে এবং স্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সহায়ক বই নামে বাড়তি চাপ থেকে মুক্ত হবে।
স্কুল পর্যায়ের এসব সহায়ক বই রচনা, ছাপানো, বাঁধাইসহ কোনো ক্ষেত্রেই সরকারি কোনো নিয়মনীতি এখন পর্যন্ত নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজ ইচ্ছায় বাণিজ্যিকভাবে এসব বই লেখক-শিক্ষকদের দিয়ে লিখিয়ে, ছাপিয়ে বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরবরাহ করে থাকে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকরা মিলে বিভিন্ন প্রকাশনীর কাছ থেকে পাওয়া বইগুলো থেকে বাছাই করে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক গ্রন্থ নির্ধারণ করেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে আর্থিক কমিশনের বিনিময়ে কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ মানের প্রতি লক্ষ্য না রেখে এসব বই নির্বাচন করে।
বাড়তি বইয়ের বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও শিক্ষা আইন প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লেখাপড়া কোনো ব্যবসা নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞানের ভিত্তিটাকে সুগঠিত করা। অনেকের ধারণা আছে, বই থেকেই শিশুরা সব কিছু শিখবে। তাই যত বেশি বই দেওয়া যায় তত ভালো। তিনি বলেন, শিশুরা মূলত পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ থেকেই যে বেশি শিখে থাকে তা অনেকে ভুলে যান। বয়স ও জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা অনুযায়ী শিশুরা কতটুকু ভার বহন ও আত্মস্থ করতে পারবে সেদিকটি চিন্তা করে তাদের উপযোগী করে বোর্ডের বইগুলো তৈরি করা হয়েছে। সে বইগুলোই শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করেন এই শিক্ষা উন্নয়ন কর্মী।
বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বোর্ডের বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক-এ তিনটি বিষয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে ধর্ম, পরিবেশ-পরিচিতি, বিজ্ঞান, ওয়ার্ড বুক, চিত্রাঙ্কন, বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা শেখার, সাধারণ জ্ঞান, নামতা-গুণ-ভাগ-জ্যামিতি আছে এমন একটি গণিত বই, ব্যাকরণ, গ্রামার, গল্প ও কবিতার এবং কম্পিউটার শিক্ষা সংক্রান্ত বই দেওয়া হয়ে থাকে। স্কুল ভেদে এসব বইয়ের সংখ্যা ও বিষয় কম-বেশি হয়ে থাকে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, বিজ্ঞান ও ধর্ম—এ ছয়টি বোর্ডের বইয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে দেওয়া হয় মূলত ব্যাকরণ, গ্রামার, কম্পিউটার, চিত্রাঙ্কন, দ্রুত পঠন ধরনের দুই থেকে ছয়টি বই। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে এসব বইয়ের সংখ্যা আরও কমে যায়।
শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের তালিকায় দেখা যায়, বাংলা ব্যকরণ ও রচনা শিক্ষা, পরিবেশ পরিচিতি প্রথম ভাগ, জানা অজানা-২, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা (প্রথম ভাগ) বা ছোটদের হিন্দু ধর্ম (প্রথম ভাগ), চিলড্রেন ওয়ার্ড বুক (১), ইংলিশ গ্রামার ট্রান্সলেশন অ্যান্ড কমপোজিশন, এসো আঁকা শিখি (১) নামে সাতটি সহায়ক বই রয়েছে। ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছয়টি সহায়ক বইয়ের মধ্যে রয়েছে—সুপার অ্যাকটিভ ইংলিশ-২, ব্রিলিয়ান্ট ওয়ার্ড বুক-ওয়ান, ছোটদের কম্পিউটার শিক্ষা—এসো কম্পিউটার শিখি, ছোটদের আরবি ও ইসলাম শিক্ষা, পরিবেশ পরিচয়-১ম ভাগ ও মাই ইজি ড্রইং-২। চতুর্থ শ্রেণিতে দেওয়া বাড়তি চারটি বইয়ের মধ্যে আছে-বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি, কমিউনিকেটিভ ইংলিশ গ্রামার অ্যান্ড কম্পোজিশন, প্রাথমিক বৃত্তি জ্যামিতি এবং এসো কম্পিউটার শিখি।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম শ্রেণিতে এ বছরও চারটি বই অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলা ব্যাকরণ একটি, ইংরেজি ব্যাকরণের দুটি এবং ড্রইং।
কিশলয় বালিকা স্কুল ও কলেজে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিশু শিক্ষার্থীদের ধর্ম ও চিত্রাঙ্কন বিষয়ে বাড়তি দুটি বই দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. রহমতউল্লাহ জানান, বিশেষ করে এ দুটি বিষয়ে বই দিতে অভিভাবকরা অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ধর্ম ও চিত্রাঙ্কন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে সরকার নির্ধারিত বই থাকলে ভালো মানের একই বই দেশের সব শিশুকে দেওয়া হতো।
বিগত মহাজোট সরকার শিক্ষার্থীদের বইয়ের বোঝা কমানোর জন্য জাতীয় শিক্ষানীতি, নতুন শিক্ষাক্রম, প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা শিক্ষা আইন ইত্যাদির মাধ্যমে উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিক ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফল প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিশুদের বইয়ের বোঝা কমানোর তাগিদ দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে নামকরা কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বই কমাতে শুরু করেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবার বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখার দুটি, বাংলা গল্পের একটি এবং ইংরেজি গ্র্যামার-এই চারটি সহায়ক বই দেওয়া হয়েছে। গত বছর ছিল ছয়টি। তার আগে ছিল আটটি। বই না থাকলেও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা নির্বাচিত কিছু ছবি আঁকা শেখান শিক্ষার্থীদের। ওই স্কুলে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণের দুটি বাড়তি বই আছে।
একজন অভিভাবক জানান, ২০১২ সালে প্রথম শ্রেণিতে বোর্ডের বইয়ের বাইরে আটটি অতিরিক্ত বই ও খাতা কিনতে প্রায় দু’হাজার টাকা লেগেছিল। এ বছর তৃতীয় শ্রেণিতে সারা বছরের খাতাসহ দুটি ব্যাকরণ বই কিনতে বাড়তি খরচ হয়েছে ৯০০ টাকা। এ ছাড়া আগে যে বইগুলো ছিল সেগুলো পড়ানোর জন্য গৃহশিক্ষকও রাখতে হয়েছিল। এবার আর সে ঝামেলা নেই।
আইডিয়াল স্কুলে বোর্ডের বইয়ের বাইরে এবার এখন পর্যন্ত কোনো অতিরিক্ত বই দেওয়া হয়নি। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ধর্ম ও সাধারণ জ্ঞানের একেবারে মৌলিক ও সহজ কিছু বিষয় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা হাতে লিখে বা আলাদা শিট দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে থাকেন বলে জানা যায়।
শিরোনাম:
শনিবার , ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ২৬ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
চাঁদপুর নিউজ সংবাদ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।