মিজান লিটন
বিনিয়োগ স্থবিরতায় নতুন শিল্প হচ্ছে না। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রবণতা। যেসব শিল্প চালু আছে অর্থনৈতিক মন্দায় সেগুলোতেও দেখা দিয়েছে রুগ্ন দশা। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদনমুখী শিল্প উৎপাদন কমাচ্ছে- যা বিরূপ প্রভাব ফেলছে কর্মসংস্থানে। যাদের কর্মের সংস্থান আছে, তাদের অনেকের মাস শেষে বেতনের নিশ্চয়তা নেই। অধিকাংশ ব্যবসায় এখন চরম মন্দা। মার্কেটগুলোতে ক্রেতা নেই। ধস নেমেছে বেচাকেনায়। খাঁ খাঁ করছে ক্রেতাশূন্য দোকানপাট। বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র জমি কেনাবেচাও থমকে আছে। দীর্ঘদিন ধরেই সারা দেশে জমির দাম পড়তির দিকে। তারপরও ক্রেতা নেই। আবাসন খাতেও স্থবিরতা। শেয়ারবাজারে মন্দা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কোথাও আশার আলো নেই। সর্বত্রই হতাশা। মন্ত্রী-আমলাদের আশ্বাস, প্রবৃদ্ধির দাবি- কাগজে-কলমেই, বাস্তবের সঙ্গে তার মিল নেই। নিত্যপণ্যমূল্য বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। ক্রেতারা বাধ্য হয়ে চাহিদার অতিরিক্ত বা ভোগ্যপণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। একেবারে জরুরি চাহিদার পণ্যটি ছাড়া তারা বাজারমুখী হচ্ছেন না। এসবের প্রভাবে সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিল্প উৎপাদনে মন্দা দিন দিনই প্রকট হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরেই বেচাকেনায় মন্দা চলছে। সংগঠিতভাবে ব্যবসায়ীরা কেউ মুখ খুলছেন না। তারা এর নাম দিয়েছেন ‘নীরব মন্দা’। তাদের মতে, এই পরিস্থিতিতে দেশের ব্যবসায়ীদের ভালো থাকার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আস্থাহীনতার কারণে দীর্ঘসময় ধরেই ভালো যাচ্ছে না তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য। এটি দৃশ্যমান না হলেও প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, সার্বিক ব্যবসায়িক পরিস্থিতি স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহ নীরব মন্দায় আক্রান্ত। এই অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে মন্দার প্রকাশ্য রূপটা বেরিয়ে পড়বে। তার আগেই এর সমাধান দরকার।সূত্র জানায়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৪ দশমিক ৭৫ শতাংশই আসে ব্যবসা খাত থেকে। পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য, হোটেল-রেস্তোরাঁ, শিল্প, নির্মাণ, রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্যান্য ব্যবসায়িক খাত এই অংশের জোগান দেয়। কিন্তু এ খাতেই চলছে চরম সংকট। পরিকল্পনা কমিশন তথ্য দিয়েছে দেশে মাথাপিছু আয় ১১৯৫ ডলারে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মাথাপিছু ওই আয় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, আয় যেটুকু বেড়েছে মূল্যস্ফীতি তা খেয়ে ফেলছে। আর মাথাপিছু আয়ের একটি বড় অংশই যাচ্ছে ধনীদের পকেটে।ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএর তথ্য মতে, ব্যবসায়িক খাতে ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন কোটি ব্যবসায়ীর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হবে ২৫ লাখের বেশি। সার্বিক পরিস্থিতি মন্দা হওয়ায় জনগোষ্ঠীর বড় এ অংশটির এখন ত্রিশঙ্কু দশা। এর নেপথ্যের কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ব্যবসা পরিচালনায় একদিকে উপর্যুপরি ট্যাক্স, শুল্ক ও ভ্যাটের বোঝা, অন্যদিকে পুঁজি বিনিয়োগে নেয়া ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ ও গলাকাটা সার্ভিস চার্জ প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরাচ্ছে ব্যবসার। সেই সঙ্গে সেবা উপকরণের দাম বৃদ্ধি, পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা আর ঘাটে ঘাটে উপরি খরচও ব্যবসার আয়কে সংকুচিত করে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় তারা পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।সরেজমিন দেখা গেছে, মন্দা সত্ত্বেও বিক্রির আশায় ব্যবসায়ীরা দোকানের পসরা খুলে বসছেন ঠিকই। কিন্তু আয়-ব্যয়ের খাতায় হিসাব মেলাতে গিয়েই বাধছে যত গণ্ডগোল। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায় নতুন পুঁজি খাটানো দূরের কথা, অনেকে পুরনো পুঁজি ভেঙে ব্যবসা সংকুচিত করে আনছেন। কেউ আবার চলমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখবেন কিনা তা নিয়েও ভুগছেন সিদ্ধান্তহীনতায়। যারা সুদিনের অপেক্ষায় কোনো মতে ব্যবসাটি আঁকড়ে ধরে আছেন, তাদের অনেককেই ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযমী কৌশল বেছে নিতে হয়েছে। এর ফলে অনেক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানকেই ছাঁটাই করতে হয়েছে দীর্ঘদিনের পুরনো কর্মীদের।সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল, রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান, হোটেল-রেস্তোরাঁ ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বর্তমান ব্যবসা-বাণিজ্যের এসব চিত্র উঠে এসেছে।মানুষের চাহিদা বাড়াতে হলে আয় বাড়াতে হবে- মন্তব্য করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আয় বাড়াতে হলে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য দেশে বেকারের চেয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে হবে বেশি। তাহলে ভোক্তারা কর্ম পরিবর্তন করে প্রতিযোগিতামূলক আয়ের পথে এগোতে পারবে। কিন্তু সেই সুযোগ কম হওয়ায় তাদের আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে মানুষের ভোগব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এ মার্কেটের ২০টি দোকানের কোনোটিতেই নেই ক্রেতা। দোকানের কর্মচারীরা ডিসপ্লে সাজিয়ে বসেছেন ঠিকই। কিন্তু ক্রেতার দেখা না মেলায় অনেককেই এ দোকান থেকে সে দোকানে পায়চারী করতে দেখা গেছে।কথা হয় প্রিয়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের একাধিক বিক্রয় প্রতিনিধির সঙ্গে। বেচাবিক্রি কেমন- প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বলে ওঠেন, নিজের চোখেই তো দেখলেন। এরপর আর কি বলব। মানুষের চাহিদা কমে গেছে, না কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে বলা মুশকিল। শুধু জানি মালিকের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। মেইন রোড-সংলগ্ন সুপরিসর এই মার্কেটেও ক্রেতার দেখা নেই। এটি গত ৮ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টার চিত্র। এই মার্কেটে চারটি ফ্লোরে প্রায় ৪৫০টি দোকান রয়েছে। ফুড আইটেমের কয়েকটি দোকানে স্কুল-কলেজ পড়–য়া কিছু শিক্ষার্থীকে অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। এছাড়া এ মার্কেটের হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া অধিকাংশ দোকানই ছিল ক্রেতাশূন্য। দোকানিরা জানান, এভাবেই চলছে এ মার্কেটের বেচাকেনা।জানতে চাইলে মার্কেটের দোতলায় অবস্থিত শাড়ির বাজারের ম্যানেজার আবু বকর সিদ্দিকী জানান, স্মরণকালের ভয়াবহ মন্দা যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। কিন্তু কেউ বলছে, কেউ বলছে না। বাস্তবতা হচ্ছে ব্যবসার পরিস্থিতি দিন দিন খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফলে ব্যয় কমাতে এরই মধ্যে ৫ জন কর্মচারী থেকে ২ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে। আগে যেখানে প্রতি মাসের বিক্রি ৭ থেকে ৮ লাখ টাকায় ওঠানামা করত, সেখানে তা কমতে কমতে নভেম্বর মাসজুড়ে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার মধ্যে। তার আগের মাসের বিক্রি মাত্র ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। অথচ দোকানে প্রতিদিন খরচই আছে ৪ হাজার টাকা। ফলে প্রতি মাসেই লোকসান হচ্ছে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি শুধু আমাদের দোকানের নয়, এ মার্কেটের প্রায় সবার অবস্থাই এক।এরপরের গন্তব্য ছিল রাজধানীর মৌচাক, আনারকলি ও সেন্টার পয়েন্ট মার্কেট। এর মধ্যে মৌচাকে বেশকিছু ক্রেতার আনাগোনা চোখে পড়লেও বেশিরভাগ ক্রেতাকেই দেখা গেছে সিজনাল পণ্যের দোকানে। অর্থাৎ শীতের পোশাকের দোকানেই ছিল ক্রেতাদের সরব উপস্থিতি। জুয়েলারি, কসমেটিক্স, ইমিটেশন, জুতা, সাধারণ পোশাক, শাড়ির দোকান, ক্রোকারিজ কিংবা অন্যান্য দোকানে ক্রেতার দেখা মিলেছে কদাচিৎ।জানতে চাইলে আনারকলি সুপার মার্কেটের প্রোপ্রাইটার সিরামিক পণ্য বিক্রেতা মিজানুর রহমান জানান, মানুষ আগে নিত্যপণ্যের চাহিদা পূরণ করে। তারপর উদ্বৃত্ত থাকলে শৌখিন পণ্য কেনায় আগ্রহ দেখায়। বছর দেড়েকের বেশি হবে এ ব্যবসায় মন্দা চলছে। আগে যেখানে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা মাসে বিক্রি হতো। এখন তা নেমে এসেছে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকায়। আগে কর্মচারী রেখেছিলাম তিনজন। এখন খরচ বাঁচাতে একজনকে বাদ দিয়ে ছোট ভাইকেও ব্যবসায় আনতে হয়েছে।