স্টাফ রিপোর্টার
বরাবরের মতো এবারও নানামুখী প্রতারণার শিকার হচ্ছেন হজযাত্রীরা। প্রতিকার চেয়ে থানা পুলিশ, হাজী ক্যাম্প, হাব অফিস- এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারস্থ হচ্ছেন তারা। তাতেও ফল না পেয়ে রাস্তায় নামছেন কেউ কেউ। প্রতি হজ মওসুমে এমন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বহু ধর্মপ্রাণ মানুষ। দৃষ্টান্তমূলক সাজা না হওয়ায় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় অপরাধীরা। এদিকে হজে গমনেচ্ছুকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে গতকাল ঢাকার আশকোনা এলাকা থেকে তিন ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। দুপুরে দক্ষিণখানে শাহজালাল আবাসিক হোটেল থেকে তাদের আটক করা হয়। প্রতারণার শিকার সেকান্দার আলী ও রবিউল ইসলাম জানান, জিয়ারতে হারামাইন ট্রাভেলস নামের একটি এজেন্সি রাজশাহী, সৈয়দপুর, শান্তাহার, লালমনিরহাট, নওগাঁসহ বেশ ক’টি জেলার অর্ধশতাধিক হজে গমনেচ্ছুকের কাছ থেকে দুই লাখ ৬৫ হাজার টাকা করে নিয়েছে। শেষ পর্যায়ে এসে এজেন্সি আরও টাকা দাবি করে। এতে গমনেচ্ছুকরা আপত্তি জানান। কয়েক দিন আগে এজেন্সির চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জয়নাল আবেদীন গা-ঢাকা দেন। গত শুক্রবার রাতে জিয়ারতে হারামাইনের নওগাঁর এজেন্ট কামরুজ্জামান কাজল, শান্তাহারের তৌহিদুল ইসলাম ও রাজশাহীর এজেন্ট হাবিব উল্লা আশকোনা এলাকার শাহজালাল হোটেলে ওঠেন। খবর পেয়ে প্রতারণার শিকার লোকজন গতকাল দুপুরের দিকে দক্ষিণখান থানাকে ঘটনাটি জানান। পুলিশ গিয়ে তিন এজেন্টকে আটক করে। সেকান্দার আলী বলেন, চুক্তি অনুযায়ী আমরা এজেন্সিকে পুরো টাকা বুঝিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন এজেন্সির তিন এজেন্ট বলছে, আমাদের ভিসা হয়ে গেছে। এখন টিকিটের টাকা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। টিকিটের টাকার ব্যবস্থা হলে সবাইকে তারা হজে পাঠাবেন। সে জন্য তারা আমাদের কাছে অতিরিক্ত টাকা দাবি করছে।
একই ভাবে গ্রুপ লিডারের প্রতারণার শিকার হয়েছেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের ১১৯ হজযাত্রী। সামা ট্রাভেলস নামের একটি হজ এজেন্সির পরিচালক পরিচয়দানকারী ওই গ্রুপ লিডার বুধবার রাতে তাদের ফ্লাইটের কথা বলে হজক্যাম্পে নিয়ে বসিয়ে রেখে নিজে গা-ঢাকা দেয়। পরে হজযাত্রীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ কৌশলে পল্টন থেকে তাকে আটক করে। প্রতারিত হজযাত্রীরা জানিয়েছেন, নয়া পল্টনের সামা ট্রাভেলসের পরিচালক পরিচয় দিয়ে গ্রুপ লিডার মাজহারুল ইসলাম সিদ্দিকী ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার ১১৯ জন হজযাত্রী থেকে বিভিন্ন হারে টাকা সংগ্রহ করে তাদের হজে পাঠানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। তিনি ২ লাখ থেকে শুরু করে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেন হজযাত্রীদের কাছ থেকে এবং এ টাকার মধ্যেই তাদের হজে পাঠানোর নিশ্চয়তা দেন। হজ ফ্লাইট শুরু হওয়ার পর এক সপ্তাহ আগে এ হজযাত্রীদের ফ্লাইটের হওয়ার কথা বলেন। কিন্তু ওই তারিখে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে আবার তারিখ পরিবর্তন করে বুধবার রাতে ফ্লাইটের কথা জানান। হজযাত্রীদের বুধবার সন্ধ্যার আগেই হজক্যাম্পে অবস্থান নিতে বলেন। হজযাত্রীরা হজ ক্যাম্পে গিয়ে জানতে পারেন যে ফ্লাইট তো দূরে থাক, তাদের বিমানের টিকিটও করা হয়নি। গ্রুপ লিডার মাজহারুল মোবাইল বন্ধ করে গা-ঢাকা দেয়। এরই মধ্যে রাতেই হজক্যাম্পে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন হজযাত্রীরা। তারা হজ অফিসের লোকজনের সহায়তা চাইলে তারা এজেন্সির অফিসে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তাদের হজ অফিস ত্যাগ করার অনুরোধ জানান। বিষয়টি পুলিশকেও জানান কয়েকজন হজযাত্রী। রাতে সামা ট্রাভেলসের দু’জন লোক এসে হজযাত্রীদের টিকিট হয়নি বলে জানিয়ে তাদের মধ্যে হজ অফিস থেকে দেয়া আইডি কার্ড বিতরণ করেন। এ সময় পুলিশ ওই দু’জনকে আটক করে তাদের কাছ থেকে গ্রুপ লিডার মাজহারুলের বিকল্প ফোন নম্বর নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে তার অবস্থানের ব্যাপারে নিশ্চিত হন। কিছুক্ষণ পরই পল্টন থানা পুলিশ মাজহারুলকে পল্টন এলাকার একটি অফিস থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে পল্টন থানা ওসি মোরশেদ আলম ও হাব নেতারা এজেন্সি মালিক এবং গ্রুপ লিডার মাজহারুলের সঙ্গে মধ্যস্থতা করেন। এরপর হজযাত্রীদের কাছ থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পূর্ণ করে তাদের পাঠানোর ব্যাপারে প্রাথমিক মধ্যস্থতা হয়। এতে গতকাল ২৫-৩০ জনের হজযাত্রার সিদ্ধান্ত হয়। তবে হজযাত্রীদের অনেকে এ মুহূর্তে অতিরিক্ত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাদের অভিযোগ, গ্রুপ লিডার তাদের তাদের জমা দেয়া টাকার মধ্যেই হজে নেয়ার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। প্রতারিত হজযাত্রী আশিকুজ্জামান জানান, বেশির ভাগ হজযাত্রীই গ্রুপ লিডারকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। এখন তাদের কাছে আরও ৩০ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে। যারা আরও কম দিয়েছেন তাদের কাছে বাকি টাকা চাওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে ২০ জন অতিরিক্ত টাকা দিয়ে যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছেন। বাকিরা প্রয়োজনে হজ অফিসে লিখিত অভিযোগ করবেন এবং তাদের দেয়া টাকার মধ্যেই হজে নেয়ার দাবিতে অটল রয়েছেন। তিনি বলেন, অনেকে বাড়ি থেকে হাতখরচের টাকা দিয়ে এসেছেন। এখন তাদের পক্ষে বাকি টাকা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আরেক হজযাত্রী আদিলুর রহমান জানান, হজ অফিস হজযাত্রীদের বিমান টিকিট ছাড়া থাকতে বারণ করছে। কিন্তু এ হজযাত্রীরা হজ অফিস ত্যাগ করেননি। তারা কোথায় যাবেন? ইতিমধ্যেই অনাহারে-অর্ধাহারে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এ ব্যাপারে হাব-এর মহাসচিব শেখ আবদুল্লাহ বলেন, গ্রুপ লিডার হজযাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে সত্য। কিন্তু হজযাত্রীরাও সরকার নির্ধারিত প্যাকেজের অনেক কম টাকা জমা দিয়েছেন। এখন যেভাবেই হোক আলোচনার মাধ্যমে হজযাত্রীদের পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে প্রায় দেড় কোটি টাকা নিয়ে সৌদি পালিয়ে গেছেন আল নাঈম নামে ট্রাভেলস এজেন্সির মালিক আবদুর রব। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর উত্তেজিত এলাকাবাসী তার খিলক্ষেত বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। এ সময় পুলিশ ওই বাড়ি থেকে ৮টি পাসপোর্ট উদ্ধার করে।
সূত্র জানায়, বরগুনা জেলার বিভিন্ন থানার ২৬ জন হজ গমনেচ্ছুক হুমায়রা ট্রাভেলস এজেন্সিতে টাকা ও পাসপোর্ট জমা দেয়। ওই এজেন্সির মালিক একই জেলার তালতলি থানার বাসিন্দা। চুক্তি মোতাবেক প্রত্যেকে সৌদি গিয়ে হজ সম্পন্ন করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত ২ লাখ ৮৫ হাজার করে টাকা দেন। এ এজেন্সির প্রধান কার্যালয় রামপুরার ৩২৩/৪ বাড়িটিতে। পরে কোন কারণবশত ওই এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেলে ওই ২৬ জনের পাসপোর্ট ও টাকা আল নাঈম এজেন্সিকে হস্তান্তর করে তারা। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীদের ৩৪ লাখ ৮০ টাকার মানি রিসিটও দেখিয়েছে হুমায়রা ট্রাভেলস। তাদের পাসপোর্ট ও টাকা আল নাঈমের মালিক আবদুর রবের কাছেই জমা ছিল। এরই মধ্যে আল নাঈম তাদের ১৬টি পাসপোর্ট আকবর এজেন্সিকে দেয়। হজ গমনেচ্ছুকরা জানান, আকবর এজেন্সি তাদের জানিয়েছে আল নাঈম আকবর এজেন্সিকে টাকা পরিশোধ করেনি। গত ২৩ তারিখে আল নাঈম এজেন্সির পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়, তাদের ফ্লাইট শুক্রবার। তাদের জন্য ঢাকার ফকিরেরপুলে আল সালাম নামে একটি হোটেল বুকিং দেয়া আছে। পরে হজ গমনেচ্ছুকরা তাদের কথামতো বুধবার বরগুনা থেকে এসে আল সালাম হোটেলে ওঠেন। কিন্তু তারপর থেকে তার সন্ধান মেলেনি আল নাঈমের কোন ব্যক্তির সঙ্গে। এরই মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন আল নাঈমের মালিক আবদুর বর তাদের টাকা নিয়ে আগেই সৌদি আরবে কেটে পড়েছেন। তাদের পাসপোর্ট আটকে রেখেছেন। বিমান টিকিটেরও কোন ব্যবস্থা করে যাননি। এদিকে আকবর এজেন্টকে দেয়া ১৬টি পাসপোর্ট বাবদও কোন টাকা আল নাঈম তাদের দেয়নি বলে জানা গেছে। এদিকে খিলক্ষেত থানায় অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল থানা পুলিশ আবদুর রবের খিলক্ষেতের বাসায় অভিযান চালিয়ে ওই ৮ জনের পাসপোর্ট উদ্ধার করেছে। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা প্রধানমন্ত্রী বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ে ওই অভিযোগের অনুলিপি দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে হজ গমনেচ্ছুক শাহানা বেগমের ছেলে এডভোকেট মুজিবুর রহমান বলেন, এখন কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। নতুন করে টিকিট করতে গেলে আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকা লাগবে। কোথায় পাবো সেই টাকা? লুৎফর রহমান বলেন, কথা ছিল বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে হজ সম্পন্ন করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত তারা খরচ বহন করবে। সে হিসেবেই তারা টাকা নিয়েছে। কিন্তু কিভাবে নবীর রওজা মোবারক জিয়ারত করতে যাবো কিছুই বলতে পারি না। এ কাফেলায় আরও আছেন গণি শিকদার, সিরাজুল ইসলাম, মো. শাহজাহান, ছালেহা বেগম, কামাল, রমিদ, মোকলেছ মাস্টার, মহসিন মাস্টার, রুস্তম আলী, আলতাফ, আম্বিয়া প্রমুখ। এদের বাড়ি বরগুনা জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এদিকে আল নাঈমের প্রতারণার শিকার হয়েছেন নাটোর ও পাবনা অঞ্চলের আরও ৪২ জন। তাদের পাসপোর্টেরও হদিস মেলেনি। এরা সবাই আল নাঈমের স্থানীয় দালাল স্থানীয় একটি মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল। নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার দাসগ্রামের হযরত আলীর মাধ্যমে ২ লাখ ৫০ হাজার করে টাকা দিয়েছিলেন। তারাও শুক্রবার সকাল ৬টা ২৫ মিনিটে তাদের ফ্লাইটের কথা শুনে ঢাকা এসেছেন। কিন্তু আসার পর এজেন্সির কোন লোককেই তারা পাননি। হযরত আলীও তাদের সদুত্তর দিতে পারেন নি। উপরন্তু সে আরও ৬ লাখ টাকা দাবি করেছিল। ওই টাকা নিয়ে গিয়ে টিকিট আনতে মতিঝিলের বলাকা অফিসে যেতে বলে। পরে সেখানে যাওয়ার আগেই আল নাঈনের লোকজন উধাও হয়ে যায়। তারা বর্তমান হাজী ক্যাম্পেই অবস্থান করছেন। এ ব্যাপারে নাটোরের সিরাজ চেয়ারম্যান বলেন, তাদের কাছে কোন কাগজপত্রই নেই। বিকালে হযরত আলী পল্টন থানায় ভুক্তভোগীদের নিয়ে গেছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।