স্টেরয়েড, ডেক্রামিথাসন, কোর্টিসল, বিটামিথাসন, হাইড্রোকর্টিসন ও প্রেডনিসলনের মতো মারাত্মক হরমোন গরু মোটাতাজা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো এতই মারাত্মক যে, গোশত রান্নার পরও তা নষ্ট হয় না। আর স্টেরয়েড মানুষের কিডনি, লিভার, অন্ধত্ব, পুরুষত্ব ও মাতৃত্বহীনতা, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গে রোগ সৃষ্টি করে। ফলে মানুষের শরীরে রোগপ্রতিরোধ মতা কমে গিয়ে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি হতে পারে। দ্রুত গরুকে মোটাতাজা করতে এসব ইনজেকশন একটি ষাঁড়গরুকে সহ্যের তুলনায় ৫ থেকে ১০ গুণ দেয়া হয় বলে পশুবিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ওই সব ওষুধ প্রয়োগে পশুর চামড়ার ভেতরে বাড়তি পানি ও চর্বি জমে বেশি মোটা দেখা যায়। এতে পশু মোটা হলেও গোশত ওজনে কম ও স্বাদহীন হয়ে পড়ে। জবাইয়ের পর গোশতে জমাট রক্ত, কালচে দাগ দেখা যায়। কোরবানির ঈদকে টার্গেট করে অতিরিক্ত লাভের আশায় কিছু ব্যাপারী ও পশু ব্যবসায়ী বাড়ন্ত, অল্পবয়সী, চিকন ও কঙ্কালসার গরু ক্রয় করে হরমোন, ইনজেকশন ও ট্যাবলেট খাইয়ে গরু মোটাতাজা করে পশুহাটে বিক্রি করে। গরুর পেছনে হাজার টাকার ইনজেকশন ও ট্যাবলেট ব্যয় করে লাখ টাকার মুনাফা করতে বেপরোয়া ব্যাপারীরা।
জানা গেছে, চোরাচালানের মাধ্যমে ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ডেক্সমেথাসন বা ওরাডেক্সন স্টেরয়েড-জাতীয় সস্তা ট্যাবলেট আসছে। পশু মালিকেরা প্রতিটি গরুকে এর যেকোনো একটির পাঁচটি ট্যাবলেট প্রতিদিন খাইয়ে থাকেন। এসব ওষুধ খাওয়ালে অল্প দিনের মধ্যে অস্বাভাবিক মোটা মনে হলেও পশু জবাইয়ের পর সে তুলনায় গোশত পাওয়া যায় না। এসব গরুই ক্রেতারা পশুহাট থেকে লাখ লাখ টাকায় কিনছেন।
পশুবিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা জানান, সরকার পশুর জন্য হরমোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এ আইন কার্যকর করতে পারলে হরমোনের ব্যবহার কমতে পারে। এর পাশাপাশি অল্টারনেটিভ কী ব্যবহার করা যায় সেটি আমাদের ভাবতে হবে। যেসব উপাদান পশুর প্রোটিন বৃদ্ধি করে এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়, তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ জন্য পশু চিকিৎসকদের অভিমত হলো, যারা কোরবানির জন্য গরু কিনবেন তারা ছোট ও স্লিম গরু এবং যেসব গরুর হাঁটাচলা স্বাভাবিক যেমন দড়ি ছিঁড়ে পালায়, মানুষ দেখলে ঢুঁস মারে, তেড়ে আসে, লাফালাফি করে ও ছোটাছুটি করেÑ এসব গরু স্বাভাবিক। এগুলোকে কেনা যাবে। তাদের মতে, সাধারণত স্বাভাবিক ও মাঝারি সাইজের গরু কেনা যেতে পারে।
পাশাপাশি অতিরিক্ত মোটা বড় গরু, যেসব গরু নড়াচড়া করে না বা নীরব, অস্বাভাবিক মুখ দিয়ে নালা ঝরে, ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না, সার্বক্ষণিক ফ্যান ও পাখা দিয়ে বাতাস ও শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে স্পঞ্জ করা হয়Ñ এসব গরু কেনা যাবে না।
এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো: জাহাঙ্গীর আলম জানান, স্টেরয়েডের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার গরুর রোগপ্রতিরোধ মতা কমিয়ে দেয়। অনেক সময় এসব হরমোনের কারণে গরুর বিভিন্ন জটিল রোগ হয়ে থাকে। এ ছাড়া এসব ওষুধ প্রয়োগে গোশতের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি বলেন, হরমোন ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ আইন কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আর পশুর প্রোটিন বৃদ্ধি করে সে ধরনের খাবার ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
এসব গরুর গোশত খাওয়ার পর তৎণাৎ অনুধাবন করতে না পারলেও মানুষের শরীরে রোগপ্রতিরোধ মতা কমে যায়, বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি হয়। শরীরে জ্বালাপোড়া হয়। অনেক সময় বন্ধ্যত্ব, মেয়েদের অল্প বয়সে পরিপক্বতা এবং শিশুদের অল্প বয়সে মুটিয়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ স্টেরয়েড হরমোন। কখনো কখনো এসব গরুর গোশত ফ্রিজে রাখলে সবুজ হয়ে যায়।
স্টেরয়েড খাওয়ানো গরু চেনার উপায় হলো যেসব গরু নীরব, ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। এসব গরুর পেছনের দিকে ঊরুর পেশিবহুল জায়গায় আঙুল দিয়ে চাপ দিলে তা দেবে যাবে। কারণ বাইরে থেকে গোশত মনে হলেও গোশতের সাথে ব্যাপক পরিমাণ পানি থাকে। কৃত্রিমভাবে মোটা করা এসব গরুকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাই না করলে মারা যায়। অনেক সময় এদের হার্ট অ্যাটাক হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের পশু চিকিৎসক ডা: আজমত আলী বলেন, কৃত্রিম হরমোন অতিমাত্রায় ব্যবহার করলে পশুর শরীরে পানি ধরে রাখতে পারে। আর গরুর গোশত ও চর্বির মধ্যে পানি ধরে রাখায় গরু মোটা হয়ে যায়। এতে গরুর কিডনি নষ্ট করে। সাধারণত গরু মোটাতাজা করেন ব্যাপারীরা। তারা একটি গরুকে ২০ থেকে ৩০টি পর্যন্ত ট্যাবলেট একত্রে খাওয়ান। কোরবানির ২১ দিন আগ থেকে ইনজেকশন দেয়া হয়। গরুর পেটে আলসার বা ফুটো হয়ে যায়। কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে যায়। এমনও দেখা গেছে, অতিরিক্ত ট্যাবলেট খাওয়ানো গরু মারা যাচ্ছে এবং ওই সব গরুর চর্বি গলে পড়ছে।
গরুকে এগুলো না খায়ানোর জন্য মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম করতে হবে। মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। কিছু মানুষের অতিমাত্রার লোভের কারণে এতে একই সাথে মানুষ ও পশুর ক্ষতি হয়। এখানে সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব সচেতনতা সৃষ্টি করা। প্রতিরোধ ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। এ ছাড়াও প্রতি বছর কোরবানির কয়েক মাস আগ থেকে খামারগুলোতে অভিযান চালানো যেতে পারে।
নারায়ণগঞ্জের গরু খামারি মো: মাহবুবুর রহমান খান বলেন, আমার খামারে প্রায় ২০০ গরু রয়েছে। আমি স্বাভাবিক নিয়মে মোটাতাজা করি। গরু মোটা করতে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি মিষ্টিকুমড়া, জাউ ও ভুসি খাওয়াই। ট্যাবলেট বা হরমোনের কাছে যাই না।
তিনি বলেন, সাধারণত স্থায়ীভাবে যারা গরুর খামার করেন তারা ট্যাবলেট খাওয়ান না। অল্প সময়ের জন্য যারা ৯০ দিনের মধ্যে গরু মোটাতাজা করেন তারাই এটি করে। এটি করা ঠিক নয়। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত থেকে ব্যাপারীরা শুকনা গরু এনে প্রচুর খাবার খাওয়ান এবং ট্যাবলেট খাওয়ানোর মাধ্যমে গরু মোটা করেন। আবার অনেকে খড়ের সাথে ইউরিয়া খাওয়ান। এসব গরু তিন থেকে চার মাসের বেশি রাখলে মারা যায়। এসব খাবার খাওয়া গরু মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। তিনি বলেন, গরুকে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি মিষ্টিকুমড়া খাওয়ালে মোটা হবে। মিষ্টিকুমড়ায় প্রচুর ভিটামিন থাকে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী কোরবানির ঈদে সারা দেশে ২০ লাখের বেশি গরু ও ৬০ লাখ ছাগলের চাহিদা রয়েছে। গরুর চাহিদার এক-চতুর্থাংশই আসে স্থানীয়ভাবে গরু মোটাতাজা করা প্রকল্প থেকে। দেশের গরুর স্বল্পতায় প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা মূল্যের ২০ থেকে ২৫ লাখ গরু বাংলাদেশে আসে।
শিরোনাম:
মঙ্গলবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
চাঁদপুর নিউজ সংবাদ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।