মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত বা দাবিদার বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকার বিভিন্ন সময় বেশ ক’বছর ক্ষমতায় থেকেও বাঙ্গালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত বা চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজটি আজ পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। অবশ্য বিভিন্ন সময় আওয়ামীলীগ সরকার এবং অন্যান্য সরকার আমলে প্রণীত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকায় নানা অসম্পূর্ণতা এবং বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যূতি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়টি সরকারের নীতি-নির্ধারকদের অবশ্যই জানা রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বাংলাদেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিরুপনের কাজে আবার হাত দিয়ে বেশ কিছুদূর আগানোর পর অজ্ঞাত কারণে তা আর শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। অর্থাৎ দেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা হিসেবে তা আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ গেজেট আকারে প্রকাশ পায়নি।
উপরন্তু ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত এবং তালিকাভূক্ত তথা তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সরকার কর্তৃক গেজেটপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে দীর্ঘ বহু বছর যাবত মারাত্মকভাবে বঞ্চিত হয়ে আছেন। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক মহলের সংক্ষিপ্ত বাক্যের সরস অভিমত; ‘-যা অবশ্যই বিশেষ রহস্যজনক বৈ কি!’ তেমনি প্রদীপের নিচে অন্ধকার হয়ে আর বজ্্র আঁটুনি ফস্কা গেড়ো’র রহস্যজনক গ্যাড়াকলে আটকে আছেন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়া তথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গেজেটপ্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বিজিবি সদস্য মোঃ হাসেম। তাঁর বিধবা স্ত্রী রহিমা বেগম তাঁদের চার কণ্যা সন্তানের অসহায় পরিবার-পরিজন নিয়ে দীর্ঘ ৪৩ বছর যাবত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা থেকে মারাত্মকভাবে বঞ্চিত। -যা স্বাধীন বাংলাদেশের একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শুধু অবজ্ঞাই নয়; নিষ্ঠুর আচরণও বটে। এই হতভাগ্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি চাঁদপুর জেলাধীন হাজীগঞ্জ উপজেলার জাখনী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মরহুম আব্দুল হামিদ।
সরজমিনে ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা যায়, বিজিবি’র হাবিলদার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হাসেম তৎকালীন ইপিআর (ইষ্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাইফেলস্) বর্তমানে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)’র একজন সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে বেশক’টি সম্মূখ সমরে অসামান্য অবদান রেখে সরাসরি পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। মৃত্যুকালে তিনি অসহায় স্ত্রী ও ৪ নাবালিকা কণ্যা সন্তান যথাক্রমে হোসনেয়ারা বেগম, ছালেহা বেগম, রাশেদা বেগম ও খোদেজা বেগমকে রেখে যান। -যা বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ সদর দপ্তরের রেকর্ড অফিসার মেজর আমিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়ন পত্রে শহীদ নাম্বার- ৯৮৭৫ হিসেবে তাঁর নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। সেইসাথে এহেন বিষয়টি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত গেজেটে নং মুবিম/ প্রঃ৩/ মুক্তিযোদ্ধা/ গেজেট/ ২০০৩/ ৪৭৯ তারিখঃ ০৪ সেপ্টেম্বর ২০০৩ ইং তারিখে ক্রমিক নাম্বার- ২৪৯৮ হিসেবে তাঁর নাম স্পষ্টভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে। এছাড়া বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট কর্তৃক ১৯৮৮ সালের প্রণীত তালিকা খন্ড-৮ এর ক্রমিক নাম্বার-১২৪০৫-এ তাঁর নাম স্পষ্টতঃ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্ত রয়েছে। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অসামান্য অবদানের প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সচিব স্বাক্ষরিত ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হাসেমকে সাময়িক সনদপত্র প্রদান করেন। কিন্তু এই সাময়িক সনদপত্রে ভুলবশতঃ ‘শহীদ মোঃ হাসেম’ না লিখে ‘মৃত মোঃ হাসেম’ লেখা হয়। যার ক্রমিক নং- ম-৭৩০২৫ এবং স্মারক নম্বর- যু বি, ম সা/ চাঁদপুর/প্রঃ-৩/২০/২০০৫/১৮৬৯। একই সাথে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হাজিগঞ্জ উপজেলাধীন ৭নং বড়কূল পশ্চিম ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আলী আশরাফ স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্রে শহীদ হাবিলদার মোঃ হাসেম, মুক্তিবার্তা নং/শহীদ নং-৯৮৭৫, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গেজেট নং ১২৪৯ হিসেবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশ রাইফেলস্- এর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, এনডিসি, পিএসসি কর্তৃক ২০০৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে শহীদ হাবিলদার মোঃ হাসেমের স্ত্রী রহিমা বেগমকে দেয়া প্রদত্ত পত্রে (নং- পিএফ/১১৮৭/ডিও) ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ বাংলাদেশ রাইফেলস্ এর ২১১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে আমন্ত্রন জানিয়ে অত্র সংস্থার অন্যান্য বীর ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হাসেম- এর অসামান্য অবদানের গৌরব গাঁথার কথা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে উল্লেখ করেন যে, ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হাসেম বাংলাদেশ রাইফেলস্- এর একজন গর্বিত সৈনিক ছিলেন যিঁনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের জীবনকে উৎস্বর্গ করে আমাদের জন্য রেখে গেছেন আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাঁর আত্মত্যাগ দেশ ও জাতি কোনোদিন ভুলবে না। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হাসেম বীরবেশে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে বেঁচে থাকবেন অনাদিকাল আমাদের মাঝে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে’। এ ব্যাপারে সেসময় তাঁর অসহায় পরিবারকে বাংলাদেশ রাইফেলস্- এর পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদানও প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ আব্দুল আজিজ ভূঁইয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মোঃ হাসেম- এর পরিবারকে ‘মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা’ প্রদানের নিমিত্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে একাধিকবার সাক্ষাত ও টেলিফোনে এমনকি ডিও লেটারের মাধ্যমে পত্রালাপ করেন। ফলশ্রুতিতে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় অত্র সংস্থার গেজেটপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মোঃ হাসেম- এর অসহায় পরিবারকেও ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্মানী ভাতার আওতাভূক্ত’ করার জন্য স্থানীয় উপজেলা/ জেলা সমাজসেবা/ ইউএনও’র সাথে যোগাযোগ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহন করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু অসহায় রহিমা বেগম উল্লেখিত সরকারি দপ্তরগুলোতে একাধিকবার যোগাযোগ করেও নানা অজুহাতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন।
এ ব্যাপারে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হাসেম- এর বিধবা স্ত্রী রহিমা বেগম গতকাল মঙ্গলবার (৩০ জুন) বিকেলে মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে জানান, ‘এতো কিছু প্রমাণ থাকার পরও শুধুমাত্র আমার স্বামীর সাময়িক সনদপত্রে ‘শহীদ মোঃ হাসেম’- এর স্থলে ‘মৃত- মোঃ হাসেম’ লিপিবদ্ধ হওয়ার কারণেই কি একটি শহীদ পরিবার মুক্তিযোদ্ধার জন্য প্রযোজ্য সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে? প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং প্রভাবশালী মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সামান্য এই ভুলের কোনো প্রতিকার পাইনি। দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে তাঁর প্রশ্ন, ভুলবশতঃ কলমে মাত্র একটি সাময়িক সনদপত্রে শহীদের স্থলে মৃত লেখায় আমার স্বামী শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাবেন কোন্ যুক্তিতে? শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বামীর এতোসব প্রমাণ পত্রের কি কোনোই মূল্য নেই? আমার স্বামী মুক্তিযুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন আর আমি সুদীর্ঘ ৪৩ বছর যাবত স্বামী হারিয়ে চার কণ্যা সন্তানদের লেখা-পড়া ও ভরন-পোষণ করতে গিয়ে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে চলেছি। আমার কোনো ছেলে সন্তান নেই, আয় রোজগার করার মতো কিংবা আমার পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। বর্তমানে আমি অর্থনৈতিক দুর্মূল্যের এই বাজারে মানবেতর জীবন যাপন করছি। সামান্য একটি মাত্র শব্দগত ভুলের ভয়াবহ দুরাবস্থা থেকে অবিলম্বে রক্ষা পাওয়ার জন্য তথা মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমার শহীদ স্বামীর আত্মত্যাগ এবং অবদানের কথা আন্তরিকভাবে বিবেচনা করে একটি শহীদ পরিবার মুক্তিযোদ্ধার প্রযোজ্য সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করণের জন্য আমি জাতির জনকের সুযোগ্যা কণ্যা মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দয়াদ্রসুলভ আশু সু-দৃষ্টি ও ত্বরিত হস্তক্ষেপ কামনা করি’।
শিরোনাম:
সোমবার , ১২ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ২৯ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
চাঁদপুর নিউজ সংবাদ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।