ঈদকে সামনে রেখে জেলার ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ বাজার ভোররাতে জমে উঠতে শুরু করেছে। করোনা সংক্রমণ রোধকল্পে পুলিশ কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিনিয়ত হানা দিচ্ছে বাজারে। তাই অনেকটাই কৌশলী হয়ে উঠে ব্যবসায়ী কিংবা ক্রেতারা। গত ক’দিন ধরে বিক্রেতারা ভোররাতে দোকান কিংবা বিপণীবিতান খুলে ফেলে আর ক্রেতাও ভোররাতে দোকানে এসে উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করছেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা বলছে, এ বাজারের ক্রেতা কিংবা ব্যবসায়ী উভয়ে পুলিশকে ভয় পায়, কিন্তু করোনাকে ভয় পায় না। যে কারণে ভোররাতে মার্কেট জমিয়ে ফেলেছে। দেশে এমন ঈদমার্কেটিং দ্বিতীয়টি আর আছে কি না তা নিয়ে সন্দিহান এখানকার স্থানীয়রা। তবে ব্যবাসায়ীদের সহযোগিতা না থাকার কারণে করোনা সংক্রমণ রোধে ঈদমার্কেট বন্ধে কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, করোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে হাজীগঞ্জের ঈদবাজার বেশ জমে উঠেছে। করোনাকে কোনো ধরনের ভয় না করে বাজারে নারী-পুরুষ সমানতালে মার্কেট করতে চলে আসতে দেখা গেছে। এখানে কোনো ধরনের লকডাউন কাজে আসছে না। এর মধ্যে পৌর মেয়র আ.স.ম. মাহবুব-উল-আলম লিপন বাজার বন্ধে উদ্যোগ নিয়ে ক্রেতার চাপ সামলাতে হিমশিম খেয়ে সেখান থেকে সরে আসেন। এরই মধ্যে পুলিশের লাঠিচার্জসহ বাজারের ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদেরকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়। এতো কিছুর পরেও ক্রেতা কিংবা বিক্রেতাকে কিছুতেই সামলে রাখা যাচ্ছে না ঈদমার্কেটিং থেকে। এ যেনো ক্রেতা-বিক্রেতা একদিকে, অপরদিকে প্রশাসনসহ পৌরসভার মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এতো কিছুর পরে এবারে ক্রেতা আর বিক্রেতারা দেদারচে বিকিকিনি করে যাচ্ছে। বিকিকিনির পরেও সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধি কিছুটা হলে যদি মেনে চলা হতো তাহলে হয়তো সংক্রমণ কিছু হলেও কম হতো বলে অনেক মনে করেন।
সরেজমিনে বুধবার হাজীগঞ্জ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পুরো বাজারের সকল বিপণীবিতানসহ ছোট-বড় গলির দোকানগুলোতে দেদারচে বিকিকিনি চলছে। কোনো দোকানেই ভিড়ের কমতি নেই। যেনো সবকিছুই স্বাভাবিক আর ঈদের মার্কেটিংয়ের পুরো ব্যস্ততা বিরাজ করছে এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে। এ সকল দোকানের দোকানিরা সেহরির পর পরই তাদের দোকান খুলে বসার আগে ক্রেতারা চলে আসে। অনেক দোকানি দোকান খুলতে এসে দেখেন তার লক্ষ্মী ক্রেতা তার দোকাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পরিবারের অন্য সকল সদস্যকে নিয়ে। যার মধ্যে নারী আর শিশুর সংখ্যাই বেশি। কোনো দোকান কিংবা বিপণী বিতানে সামাজিক দূরত্ব তো দূরের কথা, নেই জীবাণুনাশক ছিটানোর নূ্যনতম ব্যবস্থা।
আরো দেখা যায়, একেবারে কাকডাকা ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত বেশ ভালো একটা বিকিকিনি হয়ে থাকে অধিকাংশ দোকানে। ভোরবেলা ভালো ক্রেতাসমাগম হওয়ার কারণে এখন অনেক ব্যবসায়ী সেহরীর সময় দোকান খোলেন। ১০টার পর থেকে মোটামুটি গভীর রাত পর্যন্ত আরেক দফা বিকিকিনি হয় বলে ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ অভিযানে নামলে ক্রেতাসমাগম কিছু সময়ের জন্যে কমে আসে। কিছু পরেই সব স্বাভাবিক হয়ে পড়ে।
মধ্য বাজারের বড় ধরনের একটি বিপণী বিতানের সফল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ফজর নামাজের পর থেকেই কাস্টমার পাওয়া যায়। বিশেষ করে বাজারের বড় দোকানগুলোসহ কাপড়িয়াপট্টি ও বড় বড় মার্কেটের কাপড়ের দোকানগুলোতে ভোররাতেই ক্রেতা চলে আসে। এছাড়াও হকার্স মার্কেটেও উপচেপড়া ভিড় লেগেই থাকে। এ ব্যবসায়ীর মতে, করোনাকে ভয় না করে দেদারচে কেনাকাটা করছেন ক্রেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভোররাতে কারা কীভাবে বিকিকিনি চালু করছে তা কেউ বলতে পারছে না। বিশেষ করে গত ক’দিন ধরে ভোররাতে ঈদমার্কেটিং জমে ওঠা নিয়ে হাজীগঞ্জ বাজারস্থ তৎসংলগ্ন এলাকায় বেশ আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে এতো ভোরে এতো নারী-শিশু ক্রেতা বাজারে চলে আসাকে রীতিমতো কেয়ামতের নজির হিসেবে আখ্যায়িত করছেন অনেকে। করোনার মতো মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগকে ভয় না পেয়ে নারীরা তাদের সন্তানদের নিয়ে ঈদমার্কেট চলে যাওয়া, তাও আবার ভোররাতে-এটা নিয়ে অনেকেই রীতিমতো হতবাক।
বুধবার ভোরবেলা হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজারস্থ কিউসি টাওয়ারের সামনে কথা হয় বেশ ক’জন নারীর সাথে। এদের সবার সাথে ২/১ জন করে সন্তান রয়েছে। এদের একজন রুবিনা খাতুন এসেছেন কালচোঁ ইউনিয়নের সিহিরচোঁ গ্রাম থেকে। দল বেঁধে কেনো এতো ভোরে হাজীগঞ্জে এসেছেন প্রশ্ন করতে এ নারী জানান, শুনেছি দিনে আসলে বাজারে সিএনজি অটোরিকশা ঢুকতে দেয় না, আবার পুলিশ অনেককে মারে, তাই ভোরে এসেছি। কখন এসেছেন এমন প্রশ্নে এ নারী জানান, ফজরের নামাজের কিছু পরে রওনা দিয়েছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্রেতা-বিক্রেতার ভোরবেলার মার্কেটিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো লকডাউন আর পুলিশের মারপ্যাঁচ। বেশ ক’দিন ধরে পৌর মেয়রসহ পৌর কর্তৃপক্ষ, প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত আর পুলিশের অ্যাকশন চলছে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে। কার্যত ক্রেতা ঢলের কাছে এসবই যেনো বৃথা হয়ে পড়ে। উল্টো ক্রেতা-বিক্রেতা কৌশলী হয়ে ভোররাতে মার্কেট জমিয়ে ফেলেছে।
উপজেলার বলাখাল এলাকার সুবিদপুরের একজন নারী ক্রেতা জানান, বাচ্চা-কাচ্চাদের মানানো যায় না। কষ্ট হলেও তাদের জন্যে কিছু কেনাকাটা করতে হয়। অপর এক নারী ক্রেতা জানান, মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ঈদসামগ্রী (জামা-কাপড়, সেমাই, চিনি, আতপ চাল, বাদাম, কিসমিস, নারকেল ইত্যাদি) পাঠাতে হয়। তাই বাজারে এসেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে অাঁচলে মুখ ঢেকে হাসি দিয়ে বলেন, আল্লাহ ভরসা, কিছু হবে না।
এমন ভিড়ের মধ্যে হাজীগঞ্জ বাজারসহ মার্কেট করতে আসাদের মাঝে করোনা সংক্রমণের অধিক ঝুঁকি আছে। বেশ ক’জন নাম প্রকাশ না করার শর্তে চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, বাজারে ঈদের মার্কেট জমেছে ঠিক আছে। লকডাউন মানুষকে মানানো যাচ্ছে না। তবে ব্যবসায়ীরা যদি তার ক্রেতাদের জন্যে স্প্রে কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতো কিংবা সামাজিক দূরত্ব রেখে ব্যবসা করতো তাহলে হয়তোবা ঝুঁকি কিছুটা কম হতো।
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আলমগীর হোসেন রনি বলেন, লকডাউন মানাতে ও ঈদবাজারকে সামনে রেখে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে আমরা প্রতিটি মুহূর্তে কাজ করছি, কিন্তু ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে কিছুই করা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, গত ৯ এপ্রিল জেলার সাথে হাজীগঞ্জকে লকডাউনের মধ্যে আনা হয়। এরপরেই প্রশাসনের অভিযান, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের টহল এবং জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলে আসছে। কিন্তু ঈদমার্কেটিংয়ের কারণে তার সবই যেনো ভাটা পড়ে। একইভাবে সড়কগুলোতে শুধুমাত্র বাস ব্যতীত সকল ধরনের পরিবহন চলছে দেদারচে। এর মধ্যে হাজীগঞ্জে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫, আর মারা গেছেন ১ জন।