স্টাফ রিপোর্টার:
বয়সের ভারে লাঠি হাতে বৃদ্ধ। তিনি হাজীগঞ্জ-কচুয়া উপজেলার মধ্যবর্তী রঘুনাথপুর বোয়ালজুরি খালের উপর পুরোনো এই ব্রীজটি পার হচ্ছেন। বৃদ্ধের মতোই পুরোনো এ ব্রীজটির একাংশে কাঠের ছাউনি দিয়ে চলাচলের পথের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু অন্যপাশে তো ভাঙ্গা রয়ে গেল।Ñ এমন হতাশা আর দুর্দশায় দুই উপজেলার লাখো পথচারী। ব্রীজটি যেনো ওই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে করছে বাঁধাগ্রস্ত।
দুই উপজেলার তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের মাধ্যম এই ব্রীজ। অন্তহীণ দুর্ভোগের চিত্র যেন প্রতিটি মানুষের জন্য মরণ ফাঁদ। হাজীগঞ্জ উপজেলার কালচোঁ উত্তর ও কাদলা ইউনিয়নের সীমানা ব্রীজটি নির্মিত হয়েছে প্রায় ৩৭ বছর পূর্বে। বর্তমানে শুধুমাত্র ফিলারগুলো দাঁড়িয়ে আছে আর স্থানীয়দের সহযোগীতায় কাঠের তৈরি মাচা দিয়ে শিক্ষার্থী ও রঘুনাথপুর বাজারের ব্যবসায়ী ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের যাতায়াত। কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টিই পারে সমস্যাটি সমাধান করতে। তবে ব্রীজটি পুনঃনির্মাণে হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্জ অধ্যাপক আব্দুর রশিদ মজুমদার ও কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শাহজাহান শিশির দ্য রিপোর্ট টুয়ান্টিফোর ডটকমকে আশ্বস্ত করেছেন।
এ ব্রীজ দিয়ে যাতায়াত করে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তারাপালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোররা। স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ ব্রীজটির সমস্যা ও দুর্ভোগের কথা অকপটে স্বীকার করে বলেছেন, এই ব্রীজটি পথচারী ও শিক্ষার্থীদের মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী নয়ন মনি জানায়, ‘প্রতিদিন ঘর থেকে বের হলে আতঙ্কে থাকি। বিদ্যালয়ে আসার পথেই মরণ ফাঁদ। দৃশ্যমান মরণ ফাঁদ বানিয়ে ডিজিটাল সরকার আমাদের কী উপহার দিচ্ছে? আমরা আতঙ্কের মাঝে নয়, আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে বিদ্যালয়ে আসতে চাই।’
৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ মোঃ রুহুল আমিন মোল্লা ব্রীজটি সম্পর্কে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বড় ভাই আমু মোল্লা তৎকালীণ সময়ের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই সময় কচুয়া-হাজীগঞ্জবাসীর যাতায়াতের সুবিধার জন্য তিনি এই ব্রীজটি নির্মাণ করা হয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যেনো নির্দ্বিধায় বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে পারে। এরপর আর কোন মেরামত বা পুনঃনির্মাণ না হওয়ায় এমন দুর্দশাগ্রস্ত রয়েছে এই ব্রীজটি। মৃত্যুর পূর্বে ব্রীজটি নতুনভাবে নির্মাণ দেখতে পেলে আত্মা শান্তি পাবে।
স্থানীয় সমাজ সেবক মোঃ ইশাক মিয়া ব্রীজের সমস্যার বিষয়ে বলেন, গরীব-দুঃখী মানুষের কথা কেউ চিন্তা করে না। ব্রীজটির বয়স প্রায় চল্লিশ বছর। প্রায় ২০ বছর ধরে ব্রীজের উপরিভাগ ভেঙ্গে যাওয়ায় দুর্ভোগের শেষ নেই। এলাকার রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে সেটি কারো চোখে পড়ে না। ব্রীজটি যেকোন সময় পথচারী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে। এই বিষয়ে আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীরাও কোন উদ্যোগ নিচ্ছেন না। ব্রীজটি একেবারেই নড়বড়ে হওয়ায় নতুন করে নির্মাণের জন্য কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি কামনা করছি।
ব্রীজটির পাশেই থাকে মোঃ আবুল হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী। ৩-৪ বছরের ব্যবসায়ীক অভিজ্ঞতা থেকে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, বড় ধরণের দূর্ঘটনা না ঘটলেও প্রায়ই শিক্ষার্থীরা পা পিছলে পড়ে যায়। একজন আরেক জনের হাতে ধরে চলায় কিছুটা রক্ষা। বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই এই ব্রীজ দিয়ে চলাচল করে। ঐতিহ্যবাহী ও এক সময়ের স্বনামধন্য রঘুনাথপুর বাজারের সকল ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ব্রীজটি পুনঃনির্মাণের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
হাজীগঞ্জ উপজেলার ৩নং কালচোঁ উত্তর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ জামাল হোসেন দ্য রিপোর্টকে জানান, গত পাঁচ বছর পূর্বে সাবেক স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রী ও কচুয়া আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ড. মহিউদ্দিন খাঁন আলমগীর রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্রীজটি অচিরেই হবে বলে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। অদ্যাবধি এর কোন সুফল পাইনি। ব্রীজটির পরিবর্তে বিকল্প একটি ব্রীজ করলেও সেটি শিক্ষার্থী ও বাজার ব্যবসায়ীদের তেমন কোন উপকারে আসে না। ব্রীজটি দিন দিনই খসে পড়ছে। একটু মানবিক দিক চিন্তা করে চোখ বুলালেই বর্তমান সরকারের কর্তাগণ পুনঃনির্মাণে এগিয়ে আসবেন।
রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আরিফুল হাসান মানবসমাজকে জানান, বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশেই বোয়ালজুরি খাল। সাথেই ভাঙ্গা ব্রীজ। ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থীদের জীবনের কথা চিন্তা করে অচিরেই পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আনোয়ার হোসেন জানান, ‘বিকল্প ব্রীজটি ব্যবহার না করে এলাকার জনগণ ও শিক্ষার্থীরা সময় বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝরাজীর্ণ পুরাতন ব্রীজটিই ব্যবহার করছে। যে কোন মারাত্মক দূর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। পুরাতন ব্রীজটি ভেঙ্গে একই স্থানে আরেকটি ব্রীজ তৈরি করতে এখনই কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেয়া উচিত।’
জানতে চাইলে নৌকা প্রতীকে ৩নং কালচোঁ উত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মোঃ মানিক হোসেন প্রধানিয়া জানান, ‘নির্বাচিত হলে ব্রীজটি নির্মাণে আমার প্রথম পদক্ষেপ থাকবে।’
বর্তমান চেয়ারম্যান দিলদার হোসেন কিসলু দ্য রির্পোটকে জানান, দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ব্রীজটি পুনঃনির্মাণ করতে না পারলেও কাঠ দিয়ে চলাচল উপযোগী করে দিয়েছি। তবে তা ঝুঁকিমুক্ত নয়। এছাড়া সেগুলো বেশিদিন টিকে থাকে না। নিজের সামনে এর দুর্দশা দেখেও কিছু করার থাকে না। কোন দল ক্ষমতায় আছে সেটি আমার বিবেচ্য নয়। শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা যে কোন ক্ষমতাসীন দলেরই ব্রীজটি পুনঃনির্মাণে এগিয়ে আসা উচিত।
এ প্রসঙ্গে কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শাহজাহান শিশির দ্য রিপোর্টকে বলেন, বিকল্প একটি ব্রীজ রয়েছে। যেহেতু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দাবি সেহেতু বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হবে। এখন ব্রীজের নাম দিলেই সরকার অনাপত্তি করে। ফলে আরও সহজভাবে ব্রীজটি নির্মাণ করা যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে বড় ব্রীজ হওয়ায় একটু সময় লাগতে পারে।
জানতে চাইলে হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্জ অধ্যাপক আব্দুর রশিদ মজুমদার দ্য রিপোর্ট টুয়ান্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘কচুয়া উপজেলার সাথে সমন্বয় করেই ব্রীজটি নির্মাণ করা সম্ভব।’