চাঁদপুর নিউজ রিপোর্ট
প্রবাদ আছে �কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ।� হ্যাঁ এখন সেটাই চলছে। গরিব অসহায় জেলেদের হচ্ছে সর্বনাশ, আর অভিযানের নামে তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে অনেকেরই এখন পৌষ মাস। অভয়াশ্রম চলাকালীন মাছ ধরার অপরাধে জেলেদের জেলা-জরিমানা করা হচ্ছে, আর তাদের ধরা মাছ আটক করে তা বিক্রি করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে। এমন অভযোগ অভিযান পরিচালনাকারী বিভিন্ন সংস্থার কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। মাঠ পর্যায়ে এহেন কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারের জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি ভেস্তে যাচ্ছে।
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ, জাতীয় সম্পদ। এই ইলিশ রপ্তানি করে সরকার প্রচুর অর্থ আয় করে থাকে। আর এতে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ইলিশের পোনা জাটকা ও মা ইলিশ নিধন। এ জন্য সরকার বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে থাকে। আর জাটকা ধরা সব সময়ের জন্যই নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ সবচেয়ে কড়াকড়ি থাকে জাটকার বেলায় মার্চ ও এপ্রিল এ দু�মাস আর মা ইলিশের বেলায় সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবর মাসের ১১ দিন। মা ইলিশের বিষয়টি পূর্ণিমার উপর নির্ভর করে। মার্চ ও এপ্রিল ২ মাস মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চরআলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ� কিলোমিটার মেঘনা-পদ্মা নদীতে মাছের অভয়াশ্রম থাকে। অর্থাৎ এ সময়ে নদীতে সব ধরনের জাল ফেলা তথা সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। আর এ কার্যক্রম সফল করতে সরকার অভয়াশ্রমকালীন তথা মার্চ ও এপ্রিল এ দু�মাস জেলেদের প্রত্যেক পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি করে চাল প্রদান করে। চাঁদপুর জেলার চার উপজেলা হচ্ছে জেলে অধ্যুষিত। এ চার উপজেলা হচ্ছে চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ। এ চার উপজেলায় নিবন্ধনকৃত মোট জেলে পরিবার হচ্ছে ২৮ হাজার ৫৬। এরা শুধু নদীতে জাল বেয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই সরকার অভয়াশ্রমকালীন এদেরকে ৪০কেজি করে চাল সহায়তা দিয়ে থাকে। যাতে তারা এই দুই মাস নদীতে জাল ফেলা থেকে বিরত থাকে। যদিও জেলেরা ৩০-৩২ কেজির বেশি চাল পায় না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে, চাল পাওয়ার পরও জেলেরা জাল নিয়ে নদীতে নামে, জাটকা ধরে। মাঝে মধ্যে বড় ইলিশও জালে ধরা পড়ে। এ পরিমাণ শুধু চাল সহায়তায় তাদের নদীতে জাল ফেলা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। কারণ, এ দিয়ে তাদের একমাস সংসার চলে না। যে চাল দেয়া হয় তা তাদের সর্বোচ্চ ১০-১২ দিনের খোরাকি। তাছাড়া আরো যে কিছু জিনিস প্রয়োজন যেমন ডাল, লবণ, তেল ইত্যাদি সেসব কিনতে তো টাকা লাগে। টাকা উপার্জনের পথ তো দুই মাস বন্ধ। তাই বাধ্য হয়ে তারা জাল নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে। জেল-জরিমানার ভয় ও জীবনের ঝুঁকি থাকলেও তারা নদীতে মাছ ধরতে নেমে পড়ে। তাদের এ অসহায়ত্বের সুযোগটিই কাজে লাগায় কেউ কেউ। অভিযানে নেমে জেলেদের মুখের গ্রাস কেড়ে এনে তা দিয়েই কারো কারো পকেট ভারী হয়। আর অপর প্রান্তে জেলে পরিবারে চলে আর্তনাদ। অভয়াশ্রম ছাড়াও প্রতি বছর নভেম্বর থেকে পরের বছর এপ্রিল পর্যন্ত জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি পালিত হয়। এ পুরো সময় জাটকা সংরক্ষণে এবং সরকারের নির্দেশনা মানতে জেলেদের বাধ্য করতে অভিযান চালানো হয়। জেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে গঠন করা হয় জেলা টাস্কফোর্স। এই টাস্কফোর্স নদীতে অভিযান চালায়। অভিযান সবচেয়ে জোরদার করা হয় অভয়াশ্রমকালীন দু মাস। দেখা গেছে যে, অভিযান টাস্কফোর্স যৌথভাবেও করে আবার পুলিশ, ডিবি পুলিশ, কোস্টগার্ড পৃথকভাবেও করে। এসব অভিযান নিয়ে নানা কথা উঠছে। নদী থেকে আটক জাটকা নদীতেই টাকার বিনিময়ে রফাদফা করা হচ্ছে। আবার লঞ্চ থেকে জাটকা আটক করে সেগুলো অন্যত্র বিক্রি করা হচ্ছে, কিন্তু বিক্রিত টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে না। জেলে ও নৌকা আটক করে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এমন অনেক অভিযোগ রয়েছে। আর অভিযোগের তীর চাঁদপুর সদর সার্কেলের এএসপি, ডিবি পুলিশ, চাঁদপুর নৌ-ফাঁড়ি, হাইমচর ও আলুরবাজার নৌ-ফাঁড়ি পুলিশের দিকে রয়েছে। আবার জেলেদের কাছ থেকে ফিসারীর নামে টাকা উঠানো হয়। এ অভিযোগে সদর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, অভয়াশ্রম শুরুর প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ মার্চের প্রথম সপ্তাহে রাজরাজেশ্বর চর এলাকায় বড় ইলিশের একটি চালান আটক করে চাঁদপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। তারা সে চালান ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। এছাড়া হাইমচর, আলুরবাজার ও চাঁদপুর নৌ-ফাঁড়ির সদস্যদের বিরুদ্ধে জেলে ও নৌকা আটক করে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। সদর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তার নেতৃত্বে মাছের চালানীদের কাছ থেকে ফিসারীর নামে টাকা উঠানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, গত বৃহস্পতিবার রাতে সুরেশ্বর ও দক্ষিণাঞ্চলের ২টি লঞ্চে ডিবির এসআই জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন সাইজের ইলিশ আটক করে সেগুলো লঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে আনে। পরে এগুলো নিলামে না দিয়ে জনৈক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে পুরো টাকা নিজেরাই ভাগাভাগি করে নিয়ে নেয়। এছাড়া মা ইলিশ রক্ষার সময়ও ডিবির এসআই জাহাঙ্গীর অভিযানের নামে অনেক অনৈতিক কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সদর সার্কেলের এএসপি সৈকত শাহীন এএসপি রিভারের দায়িত্বে থাকায় তিনি প্রায়ই নদীতে অভিযানে নামেন। অথচ তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তা জানেন না। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে, তিনিও রাতে বিভিন্ন লঞ্চ থেকে ইলিশ ও জাটকা আটক করে সেগুলো অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন।
এভাবেই চলছে জেলেদের জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন নিয়ে কিছু লোকের অর্থ বাণিজ্যের মহোৎসব। অসহায় জেলেরা নদীতে জাল ফেলার অপরাধে জেল-জরিমানার মুখোমুখি হলেও পকেট ভারী হচ্ছে অনেকেরই। তাই ভেস্তে যাচ্ছে জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রম।