: টেবিলের ওপর কুপিবাতি রেখে তাতে ফুঁ দিয়ে কাচের টুকরা পাইপ ডাইসে ফেলে হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি তৈরি করে শাহিদা। তিন বছর ধরে এ কাজ করে শাহিদা আজ এলাকায় একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি তৈরি করেই সে সংসারে এনেছে সচ্ছলতা। টিএমএসএসের ঋণ নিয়ে ২০১০ সালে গড়ে তোলা শাহিদার কারখানায় এখন তিনজন মেয়ে ও একজন ছেলে শ্রমিক কাজ করছে। তিন বছরের ব্যবধানে শাহিদা গড়ে তুলেছে দুটি কারখানা।
দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ২০০৩ সালে চাঁদপুর হাজীগঞ্জ থানার ইয়াকুব আলীর মেয়ে শাহিদার বিয়ে হয় চাঁদপুর পৌরসভার খালিশাডুলি গ্রামের জসীমউদ্দিন গাজীর সঙ্গে। ভীরু মন, রঙিন স্বপ্ন নিয়ে শাহিদা আসে শ্বশুর বাড়ি। স্বামীর মুদি দোকানের সীমিত আয় দিয়ে নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে শাহিদা-জসিমের সংসার জীবন চলতে থাকে। এরই মধ্যে তাদের জীবনে এসে গেছে ফুটফুটে দুটি সন্তান। বাড়ে সংসারের খরচ। শাহিদা ভাবে, বাবা-মা তাকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়েছে। তার ছেলেমেয়ের জন্যও তার কর্তব্য আছে। নানা ভাবনা তাকে তাড়িত করে। পথ খুঁজে পেতে চায় শাহিদা। সে মনে মনে ভাবে, বর্তমান সময়ে মেয়েরা কত ধরনের কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা আনছে। পাশের বাড়ির মহিলা হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি তৈরি করে, সেটাও মন্দনা। কিন্তু কিছু করার জন্য প্রয়োজন টাকা। এ ভাবনা যখন তাকে ভাবিয়ে তোলে তখন, স্বামী জসীম খবর আনে টিএমএসএস অফিস ও তার কার্যক্রমের। দেরি না করে শাহিদা চাঁদপুর টিএমএসএস অফিসের ‘বাংলদেশ এগ্রো-বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রগ্রাম’ (বিএডিপি) ঋণের সদস্য হয় ২০১০ সালে। সাহস করে পাশের বাড়ির সেই মহিলার শিশি তৈরির কারখানাটি কিনে নেয় শাহিদা। তার পর শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। কাজ শুরু করে ছোট পরিসরে নিজের ঘরের এক কোণে।
শাহিদা জানায়, হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি তৈরির জন্য প্রয়োজন গ্যাসের, যা পা দিয়ে চালাতে হয় একটি যন্ত্র, যার দাম মাত্র ৩-৪ হাজার টাকা। আর লাগে কাচের চিকন পাইপ। ৬ ফুট লম্বা একটি পাইপের পাইকারি দাম ২২ টাকা। একটি পাইপ থেকে ৪০টি শিশি তৈরি করা যায়। শিশি তৈরির জন্য লোহার ডাইস প্রয়োজন। ডাইসগুলো চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করে নিতে হয়। শিশি তৈরির কৌশল খুবই সহজ। একটি টেবিলের ওপর কুপিবাতি রেখে তাতে ফুঁ দিয়ে টুকরা পাইপ ডাইসে ফেলে খুব সহজে শিশি তৈরি করা যায়। একজন কারিগর দিনে ৫০-৬০ ডজন শিশি তৈরি করতে পারে। ১২ ডজন শিশি তৈরির জন্য পারিশ্রমিক পায় ২৬-২৮ টাকা। তবে এ কাজের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শাহিদা নিজে এবং ৩ জন মেয়ে ও ১ জন ছেলেকে প্রশিক্ষিত করেছে। এখন স্বামীর মুদি দোকানের পাশের ২টি ঘরে শাহিদার কারখানা। দুই শিফটে প্রশিক্ষিত ৪ জন কাজ করছে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা। আবার বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। শিশি বিক্রি বা বাজারজাত করার কাজ নিজেরাই করে। চাঁদপুর, কুমিল্লার হোমিও চেম্বারগুলোয় যোগাযোগ করে শিশি বিক্রির ব্যবস্থা করে। বর্তমানে শিশির চাহিদা বাড়ছে, তাই ব্যবসাও ভালো চলছে। ১২ ডজনে ১ ক্রুজ শিশি সুন্দর যতœসহকারে প্যাকিং করে সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে ৪ জন শ্রমিকের পারিশ্রমিক ও আনুষঙ্গিক খরচ বাদে শাহিদা মাসে কারখানা থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ করছে। তার স্বপ্ন, কারখানাটি আরও বড় করে ভবিষ্যতে বড় বোতল, খেলনা, শোপিস ইত্যাদি তৈরি করা। আর এ জন্য প্রয়োজন একটি আধুনিক মেশিন, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ১৬ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত শাহিদা ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে ১ লাখ টাকা ঋণ চলমান আছে। অল্প অল্প করে সঞ্চয় করেছে ৭ হাজার টাকা। প্রতি মাসে জমা রাখে ডিপিএসে ১০০ টাকা করে। কিছুদিন আগেও তেমন কোনো সম্পত্তি তাদের ছিল না। বর্তমানে ১০ শতক জমির ওপর পাকা বাড়ি, ৩৬ শতক আবাদি জমিসহ পুকুর হয়েছে। আত্মপ্রত্যয়ী শাহিদা সামাজিকভাবে দারুণ সজাগ। ছেলেমেয়েদের গড়তে চায় উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, সুনাগরিক হিসেবে। বাবা-মা’র প্রতি তার কৃতজ্ঞতা অপরিসীম। তাদের দেয়া শিক্ষাই আজ তাকে এ অবস্থানে এনেছে। আর সিমাহীন কৃতজ্ঞতা টিএমএসএসের ক্ষুদ্রঋণ র্কাযক্রমের প্রতি, যা তার জীবনে এনেছে বিত্ত-বৈভব, সম্মান আর শান্তি।
==============================