এই তালিকাবিষয়ক আপিলই অনিষ্পত্তি রয়েছে ১৯ হাজার ১৫৫টি। ২০১৩ সালে অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে নতুন করে এই তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত বছরের ২৬ মার্চের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন। এত দিনেও তালিকা চূড়ান্ত করতে না পারার বিষয়ে মন্ত্রী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পারা উচিত ছিল, এতটুকু বলতে পারি। আরো আগেই পারা উচিত ছিল। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের ব্যর্থতা মনে করি।’
তবে এ বছরের ২৬ মার্চের মধ্যে ওই তালিকা প্রকাশের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এখন মনে করি, ২৬ মার্চের মধ্যে এটা হওয়া উচিত। না হলে এটা চরম ব্যর্থতা হবে।’
এ বছরের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত জামুকার বিভাগভিত্তিক অনিষ্পন্ন কাজের সারসংক্ষেপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ সালে অনলাইন ও সরাসরি মিলিয়ে প্রায় এক লাখ ৩৪ হাজার আবেদন জমা পড়ে। মামলা ও অন্যান্য কারণে ৫২টি উপজেলার আবেদন এখনো যাচাই-বাছাই বাকি। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে সর্বোচ্চ ১৬টি উপজেলা ও খুলনা বিভাগে ৯টি উপজেলার যাচাই-বাছাই প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। অন্য বিভাগগুলোতে চার-পাঁচটি করে উপজেলার কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। ৪৭টি উপজেলার যাচাই-বাছাই প্রতিবেদন পুনর্যাচাই বাকি।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশ করা হয়নি বা দ্বিধাবিভক্ত প্রতিবেদন এসেছে, এমন ব্যক্তিদের আপিল যাচাই বাকি ১৬ হাজার ৫৪৫টি। সবচেয়ে বেশি আপিল বাকি বরিশাল ও খুলনা বিভাগে যথাক্রমে চার হাজার ৮৩০টি ও চার হাজার ৭৩৬টি।
প্রাথমিকভাবে সুপারিশকৃত কিন্তু পরে পুনর্যাচাইয়ে বাদ পড়া ব্যক্তিদের আপিল যাচাইয়ের কাজ অসমাপ্ত এক হাজার ৮৯০টি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঢাকায় ৬১৮টি, রাজশাহীতে ৪৬৫টি ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৫০টি ঝুলে আছে। খুলনা ও সিলেট বিভাগে এসংক্রান্ত সব আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে।
পুলিশ বাহিনী থেকে গেজেটভুক্তির এক হাজার ১০৭টি আবেদন এখনো পড়ে আছে। এসব আবেদন পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে জামুকায় আসে। জামুকা সূত্র জানায়, এসব আবেদনের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জামুকার আইনের বাইরে প্রায় ৪০ হাজার ব্যক্তিকে গেজেটভুক্ত করা হয়। এটি বেসামরিক গেজেট নামে পরিচিত। এই গেজেট যাচাইয়ে ৪৮৭টি উপজেলার প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। শুধু একটি উপজেলার (চট্টগ্রামের রামগঞ্জ উপজেলা) প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। তবে বেসামরিক গেজেটে আপিল ও পুনর্যাচাইয়ের কিছু কাজ এখনো বাকি। গেজেট নিয়মিতকরণের আপিল যাচাই সারা দেশে বাকি ৫০৬টি।
২০১৩-১৪ সালের আবেদন ও বেসামরিক গেজেটে সব মিলিয়ে ১৯ হাজার ১৫৫টি আপিল এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
যাচাই-বাছাইয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণ : জামুকা সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন, কমিটির সদস্যদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অন্যান্য কারণে অনেক সময় প্রতিবেদন পাওয়া যায় না বা পেতে দেরি হয়। এ কারণে ২০১৯ সালে জামুকার ৬১তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যেসব উপজেলা থেকে মামলা বা অন্য কোনো কারণে প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি এবং যেসব উপজেলার প্রতিবেদনে সুপারিশকৃতের সংখ্যা বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ভাতাভোগী (সাধারণ) মুক্তিযোদ্ধাদের ১০ শতাংশের বেশি, সেসব উপজেলায় বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ে সাত সদস্যের কমিটি ভেঙে নতুন করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়।
জামুকা সূত্র জানায়, এই পুনর্যাচাইয়ের জন্য পাঠানো প্রতিবেদন এখনো কিছু জায়গায় অসম্পূর্ণ রয়েছে। অনেক জায়গায় সাত সদস্যের কমিটি ভেঙে তিন সদস্যের কমিটি করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার কারণে এখনো বেশ কিছু জায়গার প্রতিবেদন আসেনি।
উপজেলা পর্যায় থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর জামুকা আবার আট বিভাগের আটজন বিভাগীয় সদস্যকে দিয়ে প্রতিবেদনটি পুনর্যাচাই করায়। জামুকা সূত্র জানায়, এখানে এসে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটি কিছুটা ধীর হয়ে যায়। বিভাগীয় সদস্যদের বেশির ভাগ আবার নিজ নিজ এলাকার সংসদ সদস্য। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। যেহেতু প্রত্যেক বিভাগে বিভাগীয় সদস্য একজন, তাই তিনি কখন সময় দিতে পারবেন, তার ওপর পুনর্যাচাইয়ের কাজ নির্ভর করে।
‘আমলানির্ভর তালিকা নির্ভুল হতে পারে না’ : বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবারের তালিকাও নির্ভুল ও বিতর্কমুক্ত হবে না বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘এই তালিকা এত বেশি আমলানির্ভর করে ফেলা হয়েছে যে সেখানে যাচাই-বাছাই করাটা একটু কঠিন হয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করা তো আমলাদের কাজ নয়। সম্পূর্ণ আমলানির্ভর এই তালিকা কখনো নির্ভুল হতে পারে না। প্রক্রিয়াটাই আমার কাছে ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়। সরকারের উচিত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের দিয়ে কমিটি করে তাদের দিয়ে করানো। আমলারা সহযোগিতা করবেন।’