চাঁদপুর:
চাঁদপুর শহরের ট্রাকঘাট বিআইডব্লিউটিএ’র মোড় হয়ে বাগাদী রোডের মাজার এলাকার উড়ন্ত বালুর কারণে ১৫০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। একই সাথে বিঘ্নিত হচ্ছে শহরবাসীর নির্বিঘ্নে চলাফেরা ও বসবাসের পরিবেশ। ফলে জাতীয় সম্পদ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং শহরের পরিবেশ রক্ষার জন্য এ এলাকা থেকে ইট-বালুর ব্যবসা নিরাপদ স্থানে সরানোর জন্যে জেলা প্রশাসন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সাথে ইট-বালু ব্যবসার জন্য ব্যবসায়ীদেরকে উপযুক্ত স্থানের ব্যবস্থা করে দেবারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। চাঁদপুর জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, পৌর পরিষদ, বিআইডব্লিউটিএ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর সকলে মিলে এ ব্যাপারে একমত হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সভায় জেলা প্রশাসক মোঃ ইসমাইল হোসেন সংশ্লিষ্ট সকলকে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে আন্তরিক সহযোগিতা চেয়েছেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে উল্লেখিত এলাকা হতে ব্যবসায়ীদেরকে সরে যাবার জন্যে নোটিস দেয়া হবে বলে জানা গেছে। ব্যবসার জন্যে চাঁদপুর-রায়পুর সড়কের চাঁদপুর সেতুর পাশে এবং ঢালীর ঘাট এলাকায় দু’টি স্থানের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
এদিকে আগামী এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী চাঁদপুর আসার আগেই উল্লেখিত স্থানের ইট-বালু সরানোর জন্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের উপর মহল থেকে জেলা প্রশাসনের ওপর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে বলেও জানা গেছে। তাছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে নিউ ট্রাক রোড দিয়ে ইট-বালুবহনসহ ভারী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে বিদু্যৎ কেন্দ্র নির্মাণকারী সংস্থা চায়না চেংদা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের মারাত্মক চাপ রয়েছে।
উল্লেখ্য, চাঁদপুর শহরের নিউ ট্রাক রোডের বালুর মাঠ এলাকায় নির্মিত ১৫০ মেঃওঃ গ্যাস ভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল তাপ বিদু্যৎ কেন্দ্র বর্তমান সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। এটি নির্মাণে প্রায় ১হাজার ৩শ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ২০১১ সালের ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মাণ কাজের ভিত্তি ফলক উন্মোচন করেন। ১ বছর ১০ মাস পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রটি উৎপাদনে যায়। সেই থেকে দীর্ঘ ১ বছর যাবৎ এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে যোগ হচ্ছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, কেন্দ্রটি চালুর পর থেকে এ পর্যনত্দ তেমন কোনো নির্মাণ ত্রুটি না থাকলেও সামান্য অদূরে ডাকাতিয়ার তীর ঘেঁষে চলমান উড়ন্ত বালু মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়োজিত পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী (পরিচালন) জানান, এ তাপ ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় প্রচুর পরিমাণ বিশুদ্ধ বাতাসের প্রয়োজন হয়। ওই কেন্দ্রে ব্যবহৃত ১০৫৬টি (এক সেট) ফিল্টারের মাধ্যমে বাতাস ফিল্টারিং করে কেন্দ্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। প্রতি ৬ মাস অন্তর ফিল্টারগুলো একবার পরিষ্কার করার কথা থাকলেও বালির কারণে বর্তমানে প্রতি মাসে একবার করা হচ্ছে। এখন শুধু পরিষ্কারই নয়, কিছু কিছু পরিবর্তনও করতে হয়। এর জন্য মাসে প্রায় ২/৩দিন উৎপাদন বন্ধ থাকে। এতে ওই সময় পিডিবির গড়ে প্রতিদিন প্রায় সোয়া কোটি টাকা ক্ষতি হয়।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এমডি নজরুল ইসলাম বলেন, এখানে এতো বেশি বালি উড়ে যে, শক্তিশালী কমপ্রেসারের টানে এগুলো ফিল্টার হয়ে মেশিনের ভেতর ঢুকে পড়ে। এক পর্যায়ে ফিল্টারগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে উৎপাদন কেন্দ্রটি যে কোন সময় ফল্ট করতে পারে। তিনি বলেন, বিদ্যু ৎ কেন্দ্রে বালির মাধ্যমে ক্ষতির হাত থেকে রৰার জন্যে পৌর মেয়রের কাছে লিখিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন। জেলা প্রশাসনকেও বিষয়টি জানিয়েছেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী (পরিচালন) আতিয়ার রহমান আরো বলেন, বালির কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে তা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের কপিসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে। ফলে বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের ৩ সদস্যের একটি শক্তিশালী তদন্ত টিম গত ৮ মার্চ শুক্রবার সরজমিনে দেখে গেছেন। তদন্ত টিমে ছিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য উৎপাদন, প্রধান প্রকৌশলী উৎপাদন এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চাঁদপুরের একজন এডিসি। দ্রুত তারা সরকারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন বলে জানা গেছে। তাঁর মতে, যেহেতু এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাঁদপুর আসছেন সে জন্যে ওই সময়ে পূর্বেই বালি উড়া রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে চাপ রয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে আলোচনা অব্যাহত আছে।
ডাকাতিয়ার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বালির ব্যবসাকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলেছেন বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, নদীর তীর বিআইডব্লিটিএ’র এবং উপরের রাস্তার মালিক পৌরসভা। যারা এখানে ইট-বালির ব্যবসা করেছে তাদের কোনো প্রকার মালিকানা থাকার কথা না। তারপরও যদি কারো কম-বেশি জায়গা থাকে তবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের ওই জায়গায় ইট-বালির ব্যবসা বন্ধ করা উচিত। তিনি বলেন, ডাকাতিয়ার পাড়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদে তারা জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছেন। ইতিমধ্যে কিছু দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে।
পৌর মেয়র নাছির উদ্দিন আহাম্মদ বলেছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটি রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্বে পড়ে। ট্রাকঘাট এলাকাসহ ডাকাতিয়ার পাড়ে যারা বালির ব্যবসা করে তাদেরকে আমি বিকল্প স্থানে সরে যাবার অনুরোধ করেছি। একবার উচ্ছেদের চেষ্টা করেছি। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ এলাকাবাসীর সহযোগিতা পেলে বৃহত্তর স্বার্থে কাজটি যে কোনো মুহূর্তে করে দিতে প্রস্তুত আছি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁদপুরের সহকারী পরিচালক আরেফিন বাদল বলেন, আমি নিজে বেশ ক’দিন আগে ট্রাকঘাটের বালির ব্যবসায়ীদের নিয়ে পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-এর কার্যালয়ে গিয়েছি। সেখান থেকে আমাদের স্যার পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন তারা শহর ছেড়ে দিয়ে বাইরে নিরাপদ স্থানে তাদের বালির ব্যবসা সরিয়ে নেন। ব্যবসায়ীরাও তাঁর কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন। দুর্ভাগ্য, পরবর্তীতে তারা তা করেন নি। তার মতে, স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে তারা সম্ভাব্য সহযোগিতা দেবেন।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম সোহেল বলেন, ট্রাকঘাট এলাকা থেকে ইট-বালুর ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নিতে জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মহোদয় আন্তরিক এবং অনড়। ইতিমধ্যে বিষয়টি মিটিংয়ের রেজুলেশনে আনা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বালুর ব্যবসা স্থানান্তরের জন্য দু’টি স্থানের প্রসত্দাব দেয়া হয়েছে। এর একটি হচ্ছে চাঁদপুর সেতুর কাছে, অন্যটি ঢালীর ঘাট এলাকায়। যে কোনো এক স্থানে এটি সহসাই সরানো হবে। সহসাই তাদেরকে নোটিস দেয়া হবে।
পুলিশ সুপার মোঃ আমীর জাফর বলেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থে ট্রাকঘাট থেকে বালির ব্যবসা সরানো উচিত। হাতে গোণা ২/৪ জনের স্বার্থে বৃহৎ স্বার্থ নষ্ট হতে পারে না। জেলা প্রশাসন চাইলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবো।
শহরবাসী বিশেষ করে রহমতপুর আবাসিক এলাকা, বাগাদী রোড, গুনরাজদী, ট্রাক রোড, স্টেডিয়াম রোডের বাসিন্দাদের দাবি বালুর ব্যবসাটি চাঁদপুর সেতু এলাকায় নেয়া হোক। তাহলে পুরো চাঁদপুর শহর বালি মুক্ত হবে। সাথে সাথে রাতের বেলায় যন্ত্র দানব ট্রাক্টরের বিকট শব্দ দূষণ থেকে শহরবাসীর মুক্তি মিলবে। ইট-বালির অধিকাংশ ব্যবসায়ীর বক্তব্য হচ্ছে: প্রশাসন তাদেরকে উপযুক্ত জায়গার ব্যবস্থা করে দিলে তারা অবশ্যই সেই জায়গায় সরে যাবেন।
আমাদের প্রত্যাশা সব মহলের আন্তরিক সহযোগিতায় স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি উপযুক্ত স্থানে ইট-বালির ব্যবসা সরিয়ে নেয়া হবে। এতে একদিকে যেমন দেশের অত্যনত্দ গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি রক্ষা পাবে, অন্যদিকে ভয়াবহ বালি ও শব্দ দূষণ থেকে চাঁদপুর শহরবাসী রক্ষা পাবে।