পাটকল বন্ধ থাকায় পাটের ব্যাগের স্বপ্ন হাতছাড়া ষ পলিথিন ব্যাগে রাখা খাদ্যে ক্যানসারসহ জটিল রোগ হতে পারে ষ প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হয় ঢাকায় ষ নদ-নদী, ড্রেন ও মাটির উর্বরা নষ্ট করছে পলিথিন
আলতাব হোসেন
নিষিদ্ধ হওয়ার ২০ বছর পরও উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন। অতিমাত্রায় পলিথিন ও পস্নাস্টিক ব্যবহারের কারণে মানব শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ নানা রোগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনেই রাজধানীসহ সারাদেশেই পলিথিন ব্যাগের অবাধ ব্যবহার চলছে। পলিথিন ও পস্নাস্টিক পণ্য ৫০০ বছরেও মাটির সঙ্গে মেশে না। বরং মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। সেই সঙ্গে সাগর-মহাসাগরকে বিষিয়ে তুলছে বিষাক্ত পলিথিন ও পস্নাস্টিক। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে ১ মার্চ আইন করে বিষাক্ত পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। বাজার থেকে পলিথিনের ব্যবহার কমেনি। আইনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ২০ বছর ধরে বেড়েই চলেছে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার। এরপর সরকার ২০১০ সালে আরেকটি আইন করে। পলিথিনের বদলে পাটের ব্যবহারের জন্য জারি করা হয় ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’। আইনে ১১টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পস্নাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু আইনের প্রয়োগ না থাকার পুরোপুরি সুফল মিলেনি। আইনের বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তা হলে ১০ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দন্ডও হতে পারে। এক সময় পলিথিন বন্ধে অভিযান চোখে পড়লেও এখন আর দেখা যায় না। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি সংরক্ষণ এবং পরিবহণে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করে। এরপর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দুই দফায় আদেশ দিয়ে আরও ১১টিসহ মোট ১৭টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। আইন করার পর বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগের বিষয়ে মানুষ উৎসাহী হন। কাগজের তৈরি নানা ধরনের ঠোঙার ব্যবহার বাড়তে থাকে। এরপর একের পর এক পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাটের ব্যাগের স্বপ্ন অনেকটা হাতছাড়া হয়ে যায়। সরকারের একাধিক আইন, উদ্যোগ, আদেশ ও পদক্ষেপ এবং ২০২০ সালের উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকার পরও বিষাক্ত পলিথিন ও পস্নাস্টিক ব্যবহারে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। বন্ধ হয়নি পলিথিন বা পস্নাস্টিক কারখানা। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের ডিসেম্বরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় রাজধানীতে ২০০৫ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৭৮ টন পস্নাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হতো। সেখানে ২০২১ সালের হিসাব দাঁড়িয়েছে ৬৪৮ টনে। রাজধানীসহ সারাদেশে প্রায় দেড় হাজার কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে স্বল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা হয়। এ বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ডক্টর আমিনুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, আইনে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও সারাদেশে ব্যাপকহারে ব্যবহার হচ্ছে। পলিথিনের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে ১০ ফুটের বেশি পলিথিনের স্তর পড়েছে। যেগুলোর মধ্যে পলিথিন ব্যাগ ছাড়াও পস্নাস্টিকের বালতি, বোতল, পাইপ, চায়ের কাপ, খেলনা, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, কোমল পানীয়র বোতল ছাড়াও কসমেটিকসের মোড়ক, নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যসহ পলিথিন ব্যাগ রয়েছে। পলিথিন রাসায়নিক তন্তুজাতীয় দ্রব্য। বিষাক্ত ও ক্ষতিকর প্রোপাইলিনের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বনের চারটি মলিকুলের সংমিশ্রণে পলিথিন তৈরি হয়। তা নানাভাবে মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। পলিথিন ব্যাগে রাখা খাদ্য নিয়মিত খেলে মানুষ ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে ভুগবে। এতে কিডনির বিভিন্ন জটিল রোগেও হতে পারে। ইউএনডিপির পরিবেশ গবেষক ডক্টর শিমু্যয়েল বিশ্বাস যায়যায়দিনকে বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর প্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহণ নিষিদ্ধ করা হয় ২০০২ সালে। প্রায় ২০ বছর পরও ফুটপাত থেকে শুরু করে শপিং মলে অবাধে চলছে ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যবহার। কাঁচাবাজারে সামান্য কিছু একটা কিনলে তা পলিথিনে দেওয়া হয়। চাল, ডাল, মাছ, মাংস থেকে সবজির ভ্যান থেকেও সদাই করলে বিনামূল্যে মিলে। তিনি বলেন, সরকার পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন নিষিদ্ধ করলেও ৫৫ মাইক্রনের অধিক পলিথিনজাতীয় পণ্য উৎপাদনের অনুমোদন আছে। পলিথিন ৫৫ মাইক্রনের নিচে সবই অবৈধ, ৫৫ মাইক্রনের ওপরে কিছু আছে যেগুলো মাছের পোনা কিংবা গার্মেন্ট রপ্তানির কাজে ব্যবহৃত হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনুমোদিত কাঁচামাল আমদানি করেই নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে। মনিটরিংয়ে দুর্বলতার কারণে বিষাক্ত পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশজুড়ে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় এক হাজার ৩০০ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার অলিগলিতে রয়েছে প্রায় ৩০০ কারখানা। কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কাওরান বাজার, তেজগাঁও, দক্ষিণখান, টঙ্গীতে রয়েছে প্রায় হাজারখানেক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যাগ তৈরি হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৮৯৭টি অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে পাঁচ হাজার ৯৫৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২০ কোটি ৮১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। পলিথিন ব্যবহারের কারণে ৯১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। মহামারি করোনার কারণে নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ রয়েছে।