
গণভোট ও জুলাই সনদ ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াত কার্যত মুখোমুখি অবস্থানে। অনেকটা ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’র পর্যায়ে। বিএনপি বলছে, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে দেওয়া হবে না। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, নির্বাচনের আগে গণভোট দিতেই হবে। সোজা আঙুলে যদি ঘি না ওঠে তাহলে আঙুল বাঁকা করব। এজন্য ১১ তারিখ পর্যন্ত আলটিমেটাম, না মানলে ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে।
অন্যদিকে সংস্কারসহ জুলাই সনদের বিষয়ে বিএনপি স্পষ্ট করে বলেছে, ১৭ অক্টোবর সংস্কার নিয়ে আমরা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে সনদে সই করেছি, সেসব বিষয় সামনে রেখে আমাদের পথ চলতে হবে। ৮৩ কোটি টাকা খরচ করে ঐকমত্য কমিশন শুধু মিটিং আর খাওয়া-দাওয়াই করল। আর এখন সরকার বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিন সময় দেওয়া হলো, মতবিরোধ নিরসন করতে। বিএনপিকে কি আপনাদের খেলনা মনে হয়? মনে রাখবেন, বিএনপি ভেসে আসা দল নয়।
জামায়াত বলছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতেই হবে। বিএনপিসহ যেসব দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে সেটি ছাড়াই ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাবিত সুপারিশের ওপর গণভোট দিতে হবে।
গত কয়েকদিন থেকে গণভোট ও জুলাই সনদ ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা এভাবে তির্যক ভাষায় পালটাপালটি বক্তব্য দিচ্ছেন। এমনকি বক্তব্য দিতে গিয়ে নানারকম আলটিমেটাম ও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন, যা অনেক সময় রাজনৈতিক ভাষার মাত্রাবোধকেও অতিক্রম করছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বৃহস্পতিবার যশোর টাইন হল মাঠে আয়োজিত এক স্মরণসভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কড়া ভাষায় সোজাসাপটা বক্তব্য দেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। নির্বাচন বানচালের চেষ্টাও করছে। এমনকি তারা নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চায়। কিন্তু জনগণ তা কখনো মেনে নেবে না। মির্জা ফখরুল ইসলাম জামায়াতের নাম উল্লেখ না করে দলটির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করেন।
এদিকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা গত কয়েকদিন থেকে বিএনপিকে উদ্দেশ করে নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। যার সারমর্ম হলো-জনগণের স্বার্থে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় বিএনপি প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে চায় না। বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ে সরাসরি না বলতে পেরে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। মূলত ক্ষমতায় গেলে তারা এসব বাস্তবায়ন করবে না। এজন্য জামায়াত সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট এবং নোট অব ডিসেন্ট ছাড়াই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি বাস্তবায়ন করতে মরিয়া। এ দাবির সপক্ষে জামায়াত ইতোমধ্যে সমমনা আরও ৭টি দলকে তাদের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সবমিলিয়ে আট দলের ৯ নেতা বৃহস্পতিবার যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিতে যান। এর আগে আট দলের পক্ষ থেকে বেলা ১২টায় পল্টন থেকে মিছিল বের করা হয়। সেখানে সরকার এবং বিএনপির কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বক্তব্য দিতে গিয়ে এও বলেন, দাবি আদায়ে ‘সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করব।’ ওদিকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার পর মৎস্য ভবন মোড়ে এক ব্রিফিংয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জামায়াতসহ যে ৮টি দল পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে তা ১১ নভেম্বরের আগে সরকারকে মেনে নিতে হবে। তা না হলে দাবি আদায়ে মহাসমাবেশ হবে এবং ওইদিন ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে।
এদিকে জামায়াতের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কোনো জোট বা সমঝোতা না হলেও তারা নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেখতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতের এ রকম মুখোমুখি অবস্থানকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল মোটেই সাধারণ বিষয় হিসাবে দেখতে নারাজ। তারা মনে করেন, জুলাই বিপ্লবের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে যদি কোনো কারণে এই আন্দোলন মাঠে গড়ায় সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল থেকে খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। এমনকি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে ফের সংশয় দেখা দেবে। এছাড়া সমঝোতার মেয়াদ সাত দিন পার হওয়ার পর সরকার যদি একতরফাভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাতেও সংকট দূর হবে বলে মনে হয় না। মূলত এখানে সরকারেরই ভূমিকা রাখা দরকার ছিল। অহেতুক গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করা হচ্ছে। সরকারের উচিত হবে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ নির্বাচনমুখী সব দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করা।
