জিয়াউর রহমান বেলাল
অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চাঁদপুর শহরের বহুল আলোচিত স্কুল ছাত্র শাহেদ চৌধুরী (১৫) হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে ময়না তদন্তের জন্য লাশ কবর থেকে উত্তোলনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার (১২ মে) চাঁদপুরের বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অসীম কুমার শুনানি শেষে এ আদেশ প্রদান করেন। তিনি তাঁর আদেশনামায় আগামী ১৫ মে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ফরিদগঞ্জ উপজেলাধীন সুুবিদপুর চৌধুরী বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান থেকে সাহেদের লাশ উঠানোর দিন-ক্ষণ ধার্য করেন। এ লক্ষ্যে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ ইসমাইল হোসেনের কাছে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চাওয়া হলে জেলা প্রশাসক সুষ্ঠুভাবে এ দায়িত্ব সম্পাদনের নিমিত্তে চাঁদপুরের প্রথম শ্রেণীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লা সাদিতকে নিয়োগ প্রদান করেন। চাঞ্চল্যকর শাহেদ হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাঁদপুর মডেল থানার এসআই মোঃ আনোয়ার হোসেন গত ৮ মে বৃহস্পতিবার মামলার বৃহত্তর স্বার্থে ময়না তদন্তের জন্য লাশ কবর থেকে উঠানোর আবেদন করলে বিজ্ঞ আদালত গতকাল শুনানি শেষে এ আদেশ প্রদান করেন। এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় প্রিমিয়ার হাসপাতালের মালিক ডাঃ মোবারক হোসেন চৌধুরীর বাড়ির দারোয়ানকে পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে আসে।
ব্যাপক তদন্ত কার্যক্রমের পাশাপাশি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কীভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এবং হত্যার ক্লু উদ্ঘাটনের বিষয়ে অধিকতর সুনিশ্চিত হওয়ার নিমিত্তে তথা মামলার বৃহত্তর স্বার্থে কবর থেকে লাশ উত্তোলন সাপেক্ষে ময়না তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে গত ৮ মে আদালতে আবেদন করেন। আবেদনটি অধিকতর শুনানির জন্য রাখা হলে গতকাল তার শুনানি হয়।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে যত দুর্ধর্ষ অপরাধীই প্রমাণবিহীন যত গোপনে অপরাধ করুক না কেনো, ওই অপরাধী বা অপরাধীরা নিজের মনের অজান্তে হলেও কিছু না কিছু প্রমাণ কিংবা আলামত বা চিহ্ন ঘটনাস্থলে বা অন্যত্র রেখে যায়। যার তথ্য-উপাত্তের সূত্র ধরে পরবর্তীতে অপরাধের সব রহস্য উন্মোচিত হয়। তেমনি চাঁদপুর শহরে সাম্প্রতিককালে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর শাহেদ চৌধুরী হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনের বেলায়ও পুলিশ বেশ আশাবাদী। তারই ধারাবাহিকতায় পুলিশের সব চৌকস কর্মকর্তা স্থানীয়ভাবে মাঠে এবং বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে কাজ করছেন। বলা যায়, স্কুল ছাত্র শাহেদ হত্যার মূল মোটিভ ও ক্লু উদ্ঘাটনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন তাঁরা। ফলতঃ হত্যা সংর্শ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও সহায়ক আলামত এবং সিসি ক্যামেরাসহ বিভিন্ন জিনিস জব্দ করেছে পুলিশ।
চাঁদপুর জেলা শহরে সাম্প্রতিককলে সংঘটিত স্কুল ছাত্র শাহেদ চৌধুরী হত্যা সবচে’ আলোচিত ও মর্মান্তিক ঘটনা। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে রয়েছে হাজারো মানুষের ব্যাপক কৌতূহল। শুধু কৌতূহল নয়, রয়েছে নানা গুঞ্জন। শহরের প্রভাবশালী চিকিৎসকের মালিকানাধীন ফ্ল্যাট বড়ির ভাড়া বাসায় নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর রক্তাক্ত জখম করা অবশ্যই রহস্যজনক, তা বোধ করি নতুন করে বলার আর কোনো অপেক্ষা রাখে না। সে রহস্য উদ্ঘাটনে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশও মরিয়া, নাছোড়বান্দা।
গত ১১ এপ্রিল সকাল ৯টা থেকে বেলা পৌনে ১টার মধ্যে কোনো এক সময় আলিমপাড়াস্থ প্রিমিয়ার হাসপাতলের মালিক ডাঃ মোবারক হেসেন চৌধুরীর ভাড়াটিয়া ও ভাগিনা আল-আমিন স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র শাহেদ চৌধুরী (১৫) নিজ শয়ন কক্ষের মেঝেতে রহস্যজনক কারণে গুরুতর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। পরে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হলে পথে তার মৃত্যু ঘটে। থানায় কোনো কিছু না জানিয়ে বা ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ গ্রামের বাড়ি ফরিদগঞ্জ সুবিদপুৃর চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। ঘটনার পর সাহেদের অ্যাম্বুলেন্সের সাথে সাহেদের মা ও ছোট বোন হীরা ঢাকায় গেলেও রহস্যজনক কারণে তদেরকে লাশের সাথে গ্রামের বাড়িতে যেতে দেয়া হয়নি। সে থেকে তারা ঢাকায় আত্মগোপন করে লাপাত্তা থাকে। এ ব্যাপারে গত ৩০ এপ্রিল চাঁদপুরের বেশ ক’টি দৈনিক পত্রিকায় হত্যা রহস্য নিয়ে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হলে জেলার ৮ উপজেলাসহ চাঁদপুর শহরের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে দেখা দেয় ব্যাপক চাঞ্চল্য ও তোলপাড়। স্থানীয় দৈনিকগুলোতে ফলাও করে সচিত্র সংবাদ প্রকাশের পর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শাহেদ চৌধুরীর বন্ধু মহল এবং ঢাকাস্থ চাঁদপুরবাসীর যৌথ উদ্যোগে অবিলম্বে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে মানববন্ধন করা হয়। যার সচিত্র সাংবাদও স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলও শাহেদ হত্যার সচিত্র সংবাদ যথাযথ গুরুত্বের সাথে প্রচার করে। পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখির কারণে শাহেদ হত্যাকাণ্ডটি গোটা জেলায় ‘টক অব দ্যা ডিস্ট্রিক্ট’ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
গত ৩০ এপ্রিল স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে একযোগে ফলাও করে সচিত্র সংবাদ প্রকাশের পর এক সপ্তাহের মধ্যে গত ৬ মে রাতে অর্থাৎ দীর্ঘ ২৬ দিন পর হতভাগ্য শাহেদ চৌধুরীর মা নাসরিন রহমান ওরফে মিতা চৌধুরী নিজে বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামী উল্লেখ করে চাঁদপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ সময় থানায় সাহেদের ছোট বোন হীরা এবং সাহেদের খালু ও এক খালাতো ভাই উপস্থিত ছিলেন। একযোগে চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী সচিত্র সংবাদ প্রকশের পর সর্বমহলে দেখা দেয় ব্যাপক কৌঁতূহল। এতে পুলিশও বেশ নড়ে-চড়ে বসেন এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সাহেদের মামা ডাঃ মোবারকের মাধ্যমে ঢাকা থেকে সাহেদের মা ও ছোট বোন হীরাকে চাঁদপুরে আনা হয়।
অবশেষে শাহেদের মা দীর্ঘ ২৬ দিন পর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করতে বাধ্য হন। সংবাদ প্রকাশের পর থেকেই পুলিশ এহেন স্পর্শকাতর বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখে আসছেন। হত্যা মামলা দায়েরের পর পুলিশ যথারীতি রহস্য উদ্ঘাটনে মরিয়া হয়ে উঠে। চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মোঃ আমির জাফরের সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ কামরুল ইসলামের সমন্বয়ে জেলা পুলিশ, চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যাপকভাবে মাঠে নামে।