আজ ৩ ডিসেম্বর। ১৯৯০ সালের এ দিনটি ছিলো অগি্নঝরা। এ দিন স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে চাঁদপুর জেলা শহর যেন কাঁপছিলো। ৫ দিন পূর্বে চাঁদপুর শহরের চিত্রলেখা এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে ৩ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ চাঁদপুর সরকারি কলেজ শাখার তৎকালীন নেতা ও কলেজের মেধাবী ছাত্র জিয়াউর রহমান রাজু পাটোয়ারী।
১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২৭ নভেম্বর ঢাকায় বিএমএর সাধারণ সম্পাদক ডাঃ সামছুল আলম মিলন নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে বিক্ষোভের দাবানল জ্বলে ওঠে। তারই প্রেক্ষিতে পরদিন ২৮ নভেম্বর সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ওই মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন চাঁদপুর সরকারি কলেজের দ্বাদশ বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা জিয়াউর রহমান পাটোয়ারী রাজু। মিছিলটি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে চিত্রলেখা সিনেমা হল মোড়ে আসামাত্র কোনো প্রকার উস্কানি বা উত্তেজনা ছাড়াই পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। ওই সময় একটি গুলি মিছিলের সম্মুখভাগে থাকা রাজু পাটোয়ারীর শরীরে বিদ্ধ হয়। গুলিটি রাজুর শরীরে নাভীর নিচ দিয়ে ঢুকে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন সময় ছিলো সকাল ১১টা ২০ মিনিট। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে আহত রাজুকে উদ্ধার করে তখন চাঁদপুর সদর হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে আসা হয়। সদর হাসপাতালে দিনভর চিকিৎসার পর গুলিবিদ্ধ রাজুর জ্ঞান ফিরে আসে রাত ১০টায়। ওইদিন রাজুর চিকিৎসার জন্যে প্রচুর রক্তের প্রয়োজন দেখা দিলে চাঁদপুরের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়ার জন্যে হাসপাতালে ভিড় জমায়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে হাসপাতালে কমর্রত চিকিৎসক, নার্স ও বয়দের ছিলো না কোনো অবহেলা। ৪১ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের পর বেশিরভাগ রক্তই পুশ করা হয়েছিলো রাজুর শরীরে। কিন্তু দীর্ঘ চেষ্টার পরও রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায়নি। টানা ৫ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ৬ দিনের মাথায় ৩ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে জিয়াউর রহমান রাজু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ খবর বিদ্যুতের গতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে চাঁদপুর শহরে বিক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা। চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল করিম পাটোয়ারী, তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডঃ আব্দুল আউয়াল, অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলাম, এম সফিউল্যাহ, অ্যাডঃ ফজলুল হক সরকারের হস্তক্ষেপে ওই দাবানল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। হাজার হাজার শোকার্ত মানুষের শোক মিছিল ও জানাজা শেষে চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠের পশ্চিম প্রান্তে ও শহীদ মিনারের ডান পাশে শহীদ জিয়াউর রহমান রাজু পাটোয়ারীকে সমাধিস্থ করা হয়।
রাজু ছিলেন চাঁদপুর শহরের বহুল পরিচিত আজিম পাটোয়ারী (বর্তমান করিম পাটোয়ারী বাড়ি) বাড়ির মোঃ ফজলুর রহমান পাটোয়ারীর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং চাঁদপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আব্দুল করিম পাটোয়ারীর ভ্রাতুষ্পুত্রের ছেলে। ১৯৭৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজু জন্মগ্রহণ করে। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তার বয়স হয়েছিলো ১৬ বছর ১০ মাস ২ দিন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তীতে চাঁদপুরে সফরে আসলে পাটোয়ারী বাড়ির প্রতিটি ঘরে গিয়ে সাক্ষাৎ করার পর শহীদ জিয়াউর রহমান পাটোয়ারী রাজুর মা-বা ও ভাই-বোনের সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে যান। ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর ও ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল চাঁদপুরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সরকারি সফরে এসেও রাজুর পরিবারের খোঁজ-খবর নেন। রাজুর পিতা ফজলুর রহমান পাটওয়ারী ২০১৫ সালে পবিত্র হজ্ব পালন শেষে সে দেশেই মারা যান এবং জান্নাতুল বাকীতেই তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। রাজুর ভাই আতাউর রহমান পাটওয়ারী চাঁদপুর ফার্মার্স ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা।