ঢাকা: মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে জনশক্তি রপ্তানি কমছে, আবার প্রতি বছরই শ্রমিকদের একটি অংশ ফেরত আসছে। এসব প্রতিকূলতায় ধনাত্মক রেমিট্যান্স বর্তমানে রূপ নিয়েছে ঋণাত্মকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রবাসীরা ২০০৩ সালে পাঠান ৩.১৮ বিলিয়ন ডলার, ২০০৪ সালে ৩.৫৭, ২০০৫ সালে ৪.২৯, ২০০৬ সালে ৫.৪৮, ২০০৭ সালে ৬.৫৬, ২০০৮ সালে ৮.৯৮, ২০০৯ সালে ১০.৭২, ২০১০ সালে ১১ এবং ২০১১ সালে ১২.১৭ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিহাসে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স ১৪.১৭ বিলিয়ন ডলার আহরণ করে। তবে এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। ২০১৩ সালে যেখানে ধারাবাহিকভাবে জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল সেখানে উভয় ক্ষেত্রেই পিছিয়েছে। বিএমইটি ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) দুই লাখ সাত হাজার ৯৯৭ জন কর্মী বিদেশ গেছেন। ২০১৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৮ হাজার ৩৪০ জন। অথচ ২০১২ সালে একই সময়ে বিদেশ গিয়েছিলেন ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৮৩৭ জন। অর্থাৎ ২০১২ সালের চেয়ে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় পৌনে ২ লাখ জনসংখ্যা রপ্তানি কমে গেছে। ফলে ২০১২ সালের চেয়ে ২০১৩ সালে ৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা প্রবাসী আয় কম এসেছে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ১.৬%। অর্থাৎ দেশ আশানুরূপ রেমিট্যান্স আহরণে পিছিয়ে পড়েছে। অথচ বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে রেমিট্যান্স জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে। কয়েকটি দেশের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১২ সালে রেমিট্যান্স আহরণে প্রথম ছিল ভারত, ৭০ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় ছিল চীন, ৬৬ বিলিয়ন ডলার। ফিলিপাইন ও মেক্সিকো আহরণ করেছে ২৪ বিলিয়ন ডলার। নাইজেরিয়া ২১ বিলিয়ন ডলার। মিসর ১৮ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান ১৬ বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনাম ১৪ বিলিয়ন ডলার। এর নিচে ছিল অন্যান্য স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্র টোঙ্গা, পলেনিশিয়ার জনসংখ্যা এক লাখ ১০ হাজার ২৩৭ জন। এদের জিডিপিতে ৩৭.৩% অবদান রাখে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। লেসেথো ও জর্ডানের ২৪.৬% আসে রেমিট্যান্স থেকে। এ ৩টি দেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি রেমিট্যান্সের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১৮০ মিলিয়ন জনসংখ্যা মাইগ্রেট করে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রেই বৈধভাবে যায় এক মিলিয়ন ও অবৈধ পন্থায় পাড়ি জমায় প্রায় অর্ধেক মিলিয়ন মানুষ। একই চিত্র ইউরোপের দেশগুলোতেও। এছাড়া হংকং প্রতি বছর তার অভ্যন্তরীণ কাজের জন্য শ্রমিক নেয় ২ লাখ। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ জনসংখ্যা রপ্তানিকারক দেশ হলো মেক্সিকো। এ পর্যন্ত মেক্সিকো একাই যুক্তরাষ্ট্রে ৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা রপ্তানি করেছে। যাদের প্রত্যেকেই উৎপাদন, ট্রান্সপোর্টেশন ও অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত আছে। এছাড়া ফিলিপাইন যাদের জনসংখ্যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় কম, এ দেশটিও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যা রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রতি বছর এক মিলিয়ন জনসংখ্যা রপ্তানি করে। ভারত ২০০৩ সালে রেমিট্যান্স আহরণ করেছিল ৮.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭০ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের ২০০২ সালে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.২ বিলিয়ন। ফিলিপাইনও এর কাছাকাছি ছিল। একই সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার রেমিট্যান্সপ্রবাহ ছিল ৪.১ বিলিয়ন ডলার। যেখানে ২০০৩ বাংলাদেশের ছিল ৩.১৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০১৩ সালে এসে এসব দেশের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হয়েছে কয়েক গুণ। অথচ ওই সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। কিন্তু রেমিট্যান্স আহরণ সম্ভব হয়নি আশানুরূপ। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মান, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, হংকং, মালয়েশিয়া এবং সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো। বাংলাদেশের জনসংখ্যা রপ্তানি গুটিকয়েক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ যেসব দেশে জনশক্তি রপ্তানি আরও বেশি লাভজনক, সেসব দেশে আমাদের জনশক্তি রপ্তানির পরিমাণ খুবই সামান্য। অথচ মেক্সিকো, ভারত ও চীন এসব দেশে জনসংখ্যা রপ্তানি করার লক্ষ্যকে পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ার ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স পাঠানো ও জনসংখ্যা রপ্তানিকেন্দ্রিক কিছু সমস্যা রয়েছে। সরকার চেষ্টা করেও নতুন করে তেমন কোন বাজার সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রতিনিয়ত পুরনো বাজার বন্ধ হয়েছে ও হচ্ছে। সরকারের একলা চলো নীতি এ ক্ষেত্রে বড় দায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থউপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জানান, রেমিট্যান্স কমার প্রথম কারণ বিদেশে লোক কম গেছে। যা ছিল তা থেকেও ফেরত এসেছে। তিনি বলেন, এটি ছিল কূটনৈতিক ব্যর্থতা। মালয়েশিয়াসহ মধ্য প্রাচ্যেও দেশগুলোর সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক গড়ার কথা সেভাবে পারেনি। বিদেশে সেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তা-ও অকার্যকর। এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কাজ করছে। এছাড়া গত কয়েক বছরে নতুন বাজার সৃষ্টি হয়নি বরং হারিয়েছে। যাদের পাঠাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ। সব মিলিয়ে জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আহরণে সরকারের কর্মকাণ্ড অপ্রশংসনীয় বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, সরকারিভাবে কর্মী পাঠাতে গিয়ে বেসরকারি খাতকে সরকার অনেকটাই উপেক্ষা করেছে। বেসরকারির সঙ্গে সরকারের কোন সমন্বয় ছিল না। এটা মোটেই ঠিক নয়। সে কারণে জনশক্তি রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে কমছে রেমিট্যান্স। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স ধরতে হলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সবাইকে নিয়ে সরকারকে বিদেশে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যসহ সব মুসলিম দেশের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এর মূল কারণ দেশে রাজনৈতিক সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতা না থাকা। দেশে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসন চলছে। মুসলিম দেশগুলোসহ কেউ এ অবস্থা দেখতে চায় না। তাই সরকারকে গণতান্ত্রিক হতে হবে। সবার মত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে। দলীয় সংকীর্ণতার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সরকারের সঙ্গে বিদেশীদের যখন সুসম্পর্ক হবে, তখন জনশক্তি রপ্তানির দ্বার সহজে খুলে যাবে। সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু ভারতের বন্ধুত্ব নিয়ে বিশ্ববন্ধুত্ব বজায় রাখা যাবে না। মনে রাখতে হবে, ৯০ শতাংশ মুসলিম অধিবাসীর দেশে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি জনশক্তি রপ্তানির মূল বিষয়। বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়াসহ বন্ধু দেশগুলোর আস্থা রাজনৈতিকভাবে সরকারকে অর্জন করতে হবে। তাহলে জনশক্তি রপ্তানির মূল সমস্যার সমাধানে পৌঁছানো যাবে বলে মনে করেন তিনি।
শিরোনাম:
রবিবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১৩ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।