বাংলাদেশের জন্য ২০২২ সাল ছিল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড মৃত্যুর বছর। কিন্তু গত বছরের ৩ জুলাই পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল একজনের। আর চলতি বছরের একই সময় (গতকাল সোমবার) পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৫৬ জনের। আক্রান্তের সংখ্যাও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ গুণ বেশি। অর্থাৎ, এ বছর মশাবাহিত এ রোগ মহাবিপদসংকেত নিয়ে এগিয়ে আসছে।
সাধারণত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এ সময়কে ‘পিক’ বলা হয়। কিন্তু এবার জুলাই মাসের আগেই ভয়াবহ হয়ে ওঠে ডেঙ্গু।
আরেকটি আশঙ্কার কথা হলো, এতদিন ভাইরাসটির প্রজনন ও বিস্তার ছিল ঢাকা মহানগরকেন্দ্রিক। কিন্তু এবার ঢাকার বাইরেও দ্রুত সংক্রমণ ঘটছে। বিশেষ করে ঈদুল আজহার পর যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ৬০ শতাংশই ঢাকার বাইরের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টি, ঈদের ছুটি আর স্থানীয় সরকারের মশানিধন কার্যক্রমের দুর্বলতায় প্রতিনিয়ত রোগী বাড়ছে। এডিস মশার প্রজননকেন্দ্র ধ্বংস করার পাশাপাশি জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা না গেলে অতীতে সব রেকর্ড ভেঙে আরও একটি দুর্যোগের বছর দেখতে হবে বাংলাদেশকে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এতদিন জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সপ্তাহখানেক পর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটত। কিন্তু বর্তমানে আক্রান্তরা দ্রুতই শকে চলে যাচ্ছের। ফলে মৃত্যুর হার বাড়ছে। এ জন্য জ্বর চলে গেলেও বেশি করে তরল খাওয়ার পাশাপাশি বিশ্রামের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
ডেঙ্গু নিয়ে গত শুক্রবার মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন রাজধানীর মান্ডা এলাকার বাসিন্দা জুলহাস মিয়া। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘বাসার আশপাশ অনেকটা পরিষ্কার হলেও অল্প দূরত্বে খাল। সেখান থেকে মশা কামড় দিয়েছে কিনা জানি না। জ্বর হলে ওষুধ খেয়ে সেরে
উঠেছিলাম। কিন্তু দুদিন পরই অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। নিমিষেই জ্বর ১০৪ ডিগ্রিতে ওঠে। আমার বাসার আশপাশে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন।’
মুগদা হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের ৮০ শতাংশই যাত্রাবাড়ী, মান্ডা, সায়েদাবাদ ও কমলাপুরের বাসিন্দা। সেখানে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ১৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে শিশু ৪৮ জন।
হাসপাতালের কর্মীরা জানান, ঈদের পরদিন থেকে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েছে। প্রতি ঘণ্টায় ১০ থেকে ১২ জন হাসপাতালে আসছেন। যাদের শারীরিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো, তাদের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
শিশু বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. সাদিয়া চৌধুরী বলেন, ‘ঈদের আগে রোগীদের এতটা ভিড় ছিল না। শিশুরা আক্রান্ত হওয়ার পেছনে অভিভাবকদের অসচেতনতাও দায়ী। যারা আসছেন, অধিকাংশই শেষ সময়ে গিয়ে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। তারা কিছু বলতে পারে না। এ জন জ্বর হলে সবার আগে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে।’
রোগী বাড়ায় ডেঙ্গু পরীক্ষার হার বাড়িয়েছে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। আজ থেকে থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন করে আরও দুটি বুথ চালু হচ্ছে। প্রতিদিনই হাজারের বেশি ডেঙ্গু পরীক্ষা হচ্ছে সেখানে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১০৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে ২১ জন চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ডেঙ্গু কতটা ছড়িয়েছে, সেটি দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় আবারও প্রাক-মৌসুম জরিপ চালানো হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তিন হাজার ১৫০টি বাড়িতে ১৭ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত মাঠপর্যায়ের এই সমীক্ষা চালানো হয়। জরিপে ৫৪৯টি (১৭ শতাংশ) বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। দুই সিটিতেই প্রায় লার্ভা ধরা পড়ে। ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে দুই সিটির ৫০টি ওয়ার্ড। এর মধ্যে উত্তরের ২৮টি, দক্ষিণের ২২টি।
জরিপে বলা হয়, বহুতল ভবনে এডিসের উপস্থিতি ৪৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, বাসাবাড়িতে ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং নির্মাণাধীন ভবনে ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ। আজকালের মধ্যে এই জরিপের পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশ করার কথা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. ইকরামুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘বছরের শুরু থেকেই আমরা ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে সতর্ক করে আসছি। সিটি করপোরেশন যাতে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিতে পারে সে জন্যই গবেষণাগুলো চালানো হয়। এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে, পরিবেশ ঠিক না থাকলে সিটি করপোরেশনের জন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। তবে প্রধান কাজ হলো মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা, এর বিকল্প নেই। ঈদের পর যে পরিস্থিতি গুরুতর হবে, সেটি আগেই আমরা বলে এসেছি। অবশ্য বাংলাদেশেই শুধু এমন চিত্র নয়। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
ডেঙ্গুতে দেশে ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে চারজন। এই নিয়ে গত তিন দিনে মারা গেল নয়জন। এ বছর মোট মৃত্যু হয়েছে ৫৬ জনের। নতুন করে ৪৩৬ জন ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬২ জনই ঢাকার বাইরের।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির আমাদের সময়কে বলেন, ‘অধিদপ্তর অনানুষ্ঠানিকভাবে আমাদের ২২টি ওয়ার্ডকে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে। আমরা মঙ্গলবার (আজ) থেকে আরও তিনটিসহ মোট ২৫টি ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান চালাব। ভ্রাম্যমাণ আদালত তো আছেই।’
এডিস মশা কীটনাশক দিয়ে নির্মূল করা সম্ভব নয় জানিয়ে ডিএসসিসির এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এডিস মশা জন্মায় মানুষের ঘরে। কাজেই সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা জরুরি। ছাদের ফুলের টবে, এসির পানি যেখানে পড়ছে, সেখানে এডিস মশার জন্ম হচ্ছে। ফলে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ডেঙ্গুর পিক টাইম হলেও এবার আগেই শুরু হয়েছে। ফলে কার্যক্রমেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে জলাবদ্ধতা, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ডিএনসিসির সব কর্মীর ছুটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করা হয়েছে। গতকাল নগর ভবনে এক জরুরি সভায় মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডেঙ্গু যাতে কোনোভাবে ছড়িয়ে না পড়ে, তাই সংশ্লিষ্ট সব কর্মীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। জনগণের সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার আমাদের সময়কে বলেন, ‘যে গতিতে এগোচ্ছে, তা গত বছরকে ছাড়িয়ে যাবে বলাই যায়। যাত্রাবাড়ী-মান্ডাসহ রাজধানীর যেসব এলাকা হটস্পট, সেগুলোর বিষয়ে আগেই আমরা বলেছিলাম। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, কেউই নিয়ন্ত্রণ করছে না। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।’
ড. কবিরুল বলেন, ‘ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার হলে হটস্পট ম্যানেজমেন্ট দরকার হয়। ক্লাশ প্রোগ্রামের পাশাপাশি মানুষকে সর্বোচ্চ সচেতনতার সঙ্গে বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখা, জ্বর হলে মশারি টাঙানো এবং উড়ন্ত মশা ধ্বংস করতে হয়। কিন্তু এসব কার্যক্রমে অনেকটা দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে।’
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকারের দুর্বলতা স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে তা নির্ভর করে মশকের প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত ও ধ্বংসকরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততার ওপর। এই মুহূর্তে এটিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। নইলে পরিস্থিতি আরও গুরুতর পর্যায়ে চলে যাবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত আমাদের সময়কে বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা ডেঙ্গুর চারটি ধরন দেখেছি। প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রোগীর ইমিউনিটিতে (রোগ প্রতিরোধক্ষমতা) যে সমস্যা হয়, সেটির কারণে নতুন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে দ্রুত শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আগে যেখানে জ্বর হলে অন্তত এক সপ্তাহ পর ধীরে ধীরে অবনতি হতো, এখন দ্রুতই শকে চলে যাচ্ছে। এ জন্য প্রথম থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। জ¦র হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ছাড়া প্রেশার কমে যাচ্ছে কিনা, মাথা ঝিমঝিম করছে কিনা, সেসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। পানি ও তরল খাবার বেশি করে খেতে হবে। পাশাপাশি বিশ্রাম নিতে হবে।’
শিশুদের আক্রান্তের হার বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘এবার এক বছরের নিচের বাচ্চাদের আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনক। দ্রুতই তাদের অবস্থা খারাপের দিকে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনায় যেমন ঘাটতি রয়েছে, একইভাবে অভিভাবকদেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে। স্কুলের বাচ্চাদের লম্বা মোজা না পরানো এবং বাসায় মশারি না টাঙানোয় তারা আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু যে অবস্থায় গেছে, তাতে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কঠিন হবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। তারপরও মূল কাজটি অভিভাবকদের করতে হবে। নিজের বাসাটাকে অন্তত ডেঙ্গুমুক্ত রাখতে হবে।’