বাচ্চাদের দাঁতের যত্নঃ
সাধারনত ৬ মাস বয়সে বাচ্চার দাঁত উঠতে শুরু করে। তবে অনেকের ১ বছর বা তার পরেও দাঁত উঠতে পারে। দু আড়াই বছরের মধ্যে দুধের দাঁত অনেক গুলোই উঠে যায়। ৬ বছরের মধ্যে দুধের দাঁত পড়ে গিয়ে নতুন দাঁত উঠতে শুরু করে।
প্রাথমিক যতœ-
ক্স বাচ্চাকে প্রথম দাঁত মাজাতে গেলে অনেক সময় তারা কান্না জুড়ে দেয়। তাই বাচ্চা খেলার মুডে থাকলে তাকে ব্রাশ করা শেখান। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় আগে থেকে ওর মনে ভয় সৃষ্টি করাবেন না।
ক্স দাঁত ওঠার সময় সাধারনত জ্বর, ড্যাইয়্যারিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাথা হয়। এই সময় ঠান্ডা জলে তুলো ভিজিয়ে আস্তে আস্তে কম্প্রেস করতে পারেন।
ক্স ঠান্ডা দই, ম্যাশ করা ফল খেতে দিতে পারেন।
ক্স দাঁত ভাল করে ওঠার আগে এক টুকরো গজের কাপড় আঙুলে জড়িয়ে মাড়ি পরিস্কার করবেন।
ক্স ২-৩ বয়সের পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ফ্লুওরাইড টুথপেস্ট ব্যবহার করতে পারেন। এটি দাতের ক্ষয় রোগ প্রতিরোধ করে।
অভ্যেস-
ক্স দিনে দুইবার দাঁত মাজার সাথে সাথে বাচ্চাকে কোন কিছু খাওয়ার পর মুখ ধোয়ার অভ্যেস করান।
ক্স শক্ত দাঁত উঠতে শুরু করলে বাচ্চাকে নিজে দাঁত ব্রাশ করতে দিন। টুথপেস্ট যেন গিলে না ফেলে সেই দিকে খেয়াল রাখুন।
ক্স এক থেকে দের বছরের মাথাতেই বোতল বা সিপিং কাপ থেকে দুধ, ফলের রস খাওয়া বন্ধ করুন।
ক্স বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে আপনিও ব্রাশ করুন। দেখান কিভাবে ব্রাশ করতে হয়। খেলাচ্ছলে ব্রাশিং শেখান।
খাওয়া দাওয়া
ক্স চকোলেট, মিষ্টি, স্ন্যাকস, ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবনতা দাঁতের পক্ষে ক্ষতিকর। দুপুরের খাবারের সঙ্গে মিষ্টি বা দাঁতে আটকে যায় এমন স্ন্যাকস খেতে দিন, এতে অন্যান্য খাবার দাঁতের উপর ফাস্টফুডের কুপ্রভাব কমিয়ে দাঁত ভাল রাখতে সাহায্য করে।
ক্স ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ চিজ, বাদাম, ফল, শাকসবজি, ঘরে পাতানো দই, পপকর্ন, চিনি ছাড়া ক্যান্ডি বাচ্চাদের দাঁতের পক্ষে ভাল। এগুলো দিয়ে টিফিন করে দিতে পারেন।
ক্স খেয়াল রাখুন বাচ্চা যেন রাতে ফ্রুট, জুস, মিষ্টি জাতীয় খাবার খেয়ে না ঘুমিয়ে পড়ে। কারন বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়লে খাওয় বন্ধ করে দেয় আর তাতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সৃষ্ট হয়।
বয়ঃসন্ধির ও বড়দের দাঁতের যতœ
ক্স ফ্লুওরাইড টুথপেস্ট দিয়ে দিনে দুইবার দাঁত ব্রাশ করুন।
ক্স সিগারেট, তামাকজতীয় মাউথ ফ্রেশনার এড়িয়ে চলুন।
ক্স নিয়মিত চেকআপ ও দাঁত পরিস্কার রাখার জন্য বছরে একবার ডেন্টিস্টের কাছে যান।
ক্স বড় খাবারের মাঝে স্ন্যাকস, মিষ্টি কম খাওয়ায় ভাল। কারন খাওয়ার পর ব্রাশ না করলে দাঁতে ছোপ পড়বে।
বয়স্কদের দাঁতের যতœ ও খাওয়া দাওয়া
ক্স ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার দরকার।
ক্স কম প্রোটিনের চিকেন ব্রেস্ট, মাছ, গোটা দানা শস্য, লো ফ্যাট ফ্রি অথবা ডেয়ারি প্রডাক্ট যেমন দই, জি, দুধ খেতে পারেন। ফল, সবুজ শাক পাতা খান।
ক্স রিফাইনড সুগারের খাবার এড়িয়ে চলুন।
ক্স বড় খাবারের মাঝে স্ন্যাকস, মিষ্টি কম খেলেই ভাল।
বয়সকালে সাধারণত দাঁতের যে সমস্যা দেখা যায়, সেগুলি প্রতিরোধের টিপস
ক্স ড্রাই মাউথঃ কফি, তামাক জাতীয় দ্রব্য, রিফাইনড সুগারের খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রচুর পরিমানে জল খান।
ক্স ফলস টিথঃ বয়স বাড়ার সাথে সাথে দাঁতের আকার, গঠন বদলায়। দরকার পড়ে নকল দাঁতের। নিয়মিত পরিস্কার রাখা জরুরি। গরম জল দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করবেন না।
ক্স দাঁতে ক্যাভিটিঃ সার্কুলার মুভমেন্ট হালকা হাতে ব্রাশ করা জরুরি।
ক্স মাড়িতে ব্যাথাঃ বয়েস কালে অনেক সময় খাবার চিবতে গেলে মাড়িতে লাগে। ডেয়ারি প্রডাক্ট, শস্য, মাংস, ফল, সবজি নিয়ে ব্যালান্সড ডায়েট জরুরি।
দাঁত ভাল রাখার প্রাথমিক নিয়ম
দাঁত মাজা ঃ
ওরাল হাইজিন মেনটেন করার জন্য ব্রাশিং জরুরি। মুখে গর্ত, দাঁতে গর্ত অনেক সময় ব্রাশিং এর কারনে নিয়ন্ত্রিত থাকে।
ব্রাশ করার টেকনিকঃ
ক্স নিয়মিত ব্রাশ করুন। দিনে দুবার।
ক্স অন্তত ২ থেকে ৩ মিনিট সময় নিয়ে ব্রাশ করুন।
ক্স দাঁত ও মাড়ির উপর হালকা হাতে সার্কুলার মভমেন্টে ব্রাশ করতে পারলে ভাল।
ক্স খাবার চিবিয়ে খান দাঁতের যে অংশ দিয়ে, সেই অংশটি ভাল করে ব্রাশ করবেন। না হলে খাবারের টুকরো জমে থেকে দাঁত অপরিস্কার থাকবে।
কি রকম টুথব্রাশ বাছবেনঃ
ক্স নরম সিনথেটিক ব্রিসলের ব্রাশ ব্যাবহার করুন।
ক্স পেছনের সারির দাঁতে, দাতের ফাকে স্বচ্ছন্দে ব্রাশ করতে পারবেন এইরকম ব্রাশ কিনুন।
কখন টুথব্রাশ বদলাবেন ঃ
ক্স ৩ থেকে ৪ মাস পর পর ব্রাশ বদলান। কারন ব্রিসল গুলো নষ্ট হলে দাঁত ভালমত পরিষ্কার হয় না।
ক্স টুথব্রাশের মাথার দিকের ব্রিসল গুলো গোড়া থেকে নড়বড়ে হলে বুঝবেন নতুন ব্রাশ কিনতে হবে।
ক্স ঠান্ডা লাগার পর বা ইনফ্লুয়েনজার পর ব্রাশ বদলাতে পারলে ভাল।
কিভাবে টুথব্রাশ ভাল রাখবেনঃ
ক্স ভালকরে ব্রাশ ধুয়ে সোজাভাবে রাখবেন। তাড়াতাড়ি জল শুকিয়ে যাবে।
ক্স বাক্সবন্দি না করে খোলা যায়গাতে রাখুন।
ক্স একই টুথব্রাশ যেন একজনই ব্যবহার করে।
টুথপেস্টঃ
ক্স সেনসিটিভ দাতের জন্য ডিসেন্সিটাইজিং টুথপেস্ট ব্যবহার করুন। এর পটাসিয়াম নাইট্রেট দাঁত ভাল রাখে।
ক্স সোডিয়াম পাইরোফসফেট দাঁতের ছাতার দাগ তুলতে না দিলেও মাড়ির ছাত পড়তে দেয় না।
ক্স অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল টুথপেস্ট ব্যাকটেরিয়া দুর করে।
ক্স বেকিং সোডা সমৃদ্ধ পেস্ট ব্যবহার করলে দাত ফ্রেস থাকে।
মাউথ ওয়াসঃ
ক্স ফ্লোরাইড মাউথ ওয়াস দাঁতের এনামেল মজবুত করে।
ক্স অ্যান্টিপ্লাক মাউথ ওয়াস দাত থেকে হলুদ ছোপ দুর করে।
ক্স টোব্যাকো স্টেন রিমুভার মাউথ ওয়াস সিগারেট, তামাকের দাগ পরিস্কার করে। ন্যাচারাল মাউথ ওয়াস অ্যালকোহল ও সুগার ফ্রি।
দাঁত সুন্দর রাখার আধুনিক পদ্ধতি
ব্লিচিং অথবা টুথ হোয়াইটনিংঃ
ব্লিচিং পদ্ধতির সাহায্যে দাঁতের ঝকঝকে সাদা ভাব ফিরিয়ে আনা হয়। যাদের এমনিতেই দাঁতের স্বাস্থ ভাল, অন্য কোনও সমস্যা নেই, তাদের জন্য টুথ লাইটনিং আদর্শ।
‘অ্যাট হোম টেকনিক’ এ মাইল্ড ব্লিচিং জেল দেওয়া বিশেষ ধরনের কাস্টম ট্রে প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা করে পেশেন্টকে পরে থাকতে বলা হয়। এই পদ্ধতির সব থেকে বড় সুবিধে হল বাড়িতে বসে নিজের সুবিধে মত সময়ে করা যায়। মাইল্ড ব্লিচিং জেল দেওয়া থাকে বলে ভয়ের কিছু থাকে না। অন্য পদ্ধতিটি ‘ইন অফিস টেকনিক’। ডাক্তারের চেম্বারে বিশেষ ধরনের ব্লিচিং জেলের সাহায্যে করা হয়।
কসমেটিক কন্ট্যুরিংঃ
এই পদ্ধতিতে দাঁতের সারির গঠন মেরামত করা হয় এবং এলোমেলো দাঁতের সারিকে সোজা দেখায়। দাঁতে সামান্য ফ্রাকচার বা দাঁত ফাকা হলেও এই পদ্ধতিতে তা সারিয়ে নেয়া যায়। বেশি ঠাসাঠাসি দাতকেও হালকাভাবেও সাজানো যায়।
কম্পোজিট বন্ডিংঃ
দাঁতের গঠন ও রঙের উন্নতি ঘটাতে দরকার কম্পেজিট বন্ডিং। ছোট দাঁত লম্বা করতে, বাকা দাঁত সোজা করতে, দাঁতের দাগ তুলতে, রং ফেরাতে, দাঁতের ফাটল সারাতে, দাঁতের গর্ত সারাতে, পুরনো ফিলিং ঠিক রাখতে জরুরি। দাঁতের উপর প্রথমে মাইল্ড অ্যাসিড দিয়ে কন্ডিশন করে তারপর বডিফ্লুইড দিয়ে দাঁত ঢেকে দেওয়া হয়। শেষে কম্পোজিট মেটিরিয়ালে চাহিদা মতো গঠন দেওয়া হয়। বন্ডিংয়ের পর বরফ, আপেল, ভুট্টা কামড়ে খাওয়ার চেষ্টা করবেন না।
পোর্সেলিন ভিনিয়ার্সঃ
বিশেষ ভাবে তৈরী পোর্সেলিনের পাতলা সেমি-ট্রান্সলিউসেন্ট শেল, প্লেটস বা ল্যামিনেটস তৈরী করে স্বাভাবিক দাঁতের ওপর বসানো হয়। হাসলে মাড়ি দেখা গেলে বা ফিলিং ক্ষয়ে গেলে এই পদ্ধতি উপকারি।
ফ্লসিংঃ
বিশেষ সুতোর সাহায্যে দুটো দাঁতের মাঝখানে যেখানে ব্রাশ করা যায় না, সেই যায়গার দাগ ছোপ পরিষ্কার করা হয়। দাঁতের মাঝে ফ্লসিং করার সময় হালকা হাতে করবেন না এতে মাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পরে।
স্কেলিংঃ
এই পদ্ধতিতে মাড়ির স্বাস্থ ভাল থাকে। মাড়ি দৃঢ় থাকে। দাঁতের ছাতা, ছোপ স্কেলিং এর সাহায্যে দূর করা যায়। এই পদ্ধতিতে দাঁতের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। ৬ মা পর পর স্কেলিং করাতে পারেন।
রুট ক্যানেলঃ
এই পদ্ধতিতে দাঁতের ড্যামেজড পাল্প অংশটা বের করে দঁতের ভিতরের অংশটা ফিল করা হয়। এই পাল্পের নরম অংশে নার্ভ, কানেকটিভ টিস্যু, রক্ত কনিকা থাকে। পেছনের সারির দাঁতের জন্য একাধিক সিটিংয়ের দরকার হয়।
পেগনেন্সি ও দাঁতের যতœঃ
ক্স মায়ের দুধের ক্যালসিয়াম বাচ্চার দাঁতের গঠন করে।
ক্স প্রেগনেন্ট থাকা অবস্থায় অনেকের প্রেগনেন্সি জিনজিভাইটিস দেখা যায়। মাড়ি ফুলে লাল হয়। সকালে ব্রাশিংয়ে মর্নিং সিকনেস হলে অ্যান্টি প্লাক বা ফ্লুরাইড মাউথ ওয়াশ দিয়ে মুখ ধুতে পারেন। ভিটামিন সি ও বি১২ সমৃদ্ধ খাবার খান।
ক্স সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারের শুরুতে অবশ্যয় ডাক্তার দেখাবেন।
ক্স কসমেটিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা গুলো বাচ্চা হওয়ার পর করানো উচিৎ।
ডাঃ রাহুল মিত্র
বিডিএস, এমপিএইচ, এমবিএ
এসিসট্যান্ট প্রফেসর, এসআইএমটি
চেম্বারঃ আল হেলাল স্পেশ্যালাইজড হাসপাতাল লিঃ
মিরপুর ১০, ঢাকা ১২১৬
মোবাইলঃ ০১৭১২ ৬৮০০৮৭