চিত্রনায়িকা শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড কী তথ্যের ভিত্তিতে মঞ্জুর করা হয়েছে, দুই বিচারকের কাছে সেই ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। রিমান্ড মঞ্জুরকারী ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দুই বিচারককে (ম্যাজিস্ট্রেট) ১০ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুই বিচারক সম্পর্কে আদালত বলেছেন, তাঁরা যদি সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারেন, তবে তাঁদের সশরীরে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেওয়া হবে।
এ ছাড়া মাদক আইনে পরীমনির বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর মামলার নথিসহ (সিডি) তাঁকে সশরীরে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এই আদেশ দিয়েছেন। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পরবর্তী আদেশের দিন ধার্য করেছেন আদালত। পরীমনিকে রিমান্ডে নেওয়ার বৈধতা প্রশ্নে হস্তক্ষেপ চেয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) করা এক আবেদনে আবেদনকারীপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শোনার পর এই আদেশ দেন হাইকোর্ট।
আসকের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, মো. মুজিবুর রহমান ও ড. সৈয়দা নাসরিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইয়াহিয়া দুলাল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান।
হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুরের সময় কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে রিমান্ড মঞ্জুর করা প্রয়োজন? প্রথম চার দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে এমন কী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল যে অভিযুক্তকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে নিতে হবে? আদালত বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা চাইলেন আর তাতেই কিভাবে সংবিধান ও দেশের অন্যান্য আইন লঙ্ঘন করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুর করে দিলেন মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট, এটা বুঝে আসে না।
আদালত বলেন, পুলিশ বিভাগকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে মানুষের জীবন হচ্ছে খুবই মূল্যবান সম্পদ। কোনো ব্যক্তিকে রিমান্ডে নেওয়ার আগে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রথমেই আইন দেখতে হবে এবং রিমান্ডে নেওয়ার ভিত্তি কী, তা চিন্তা করতে হবে।
উচ্চ আদালত বলেন, একজন তদন্ত কর্মকর্তার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া গাইডলাইন অস্বীকার করা বা তার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত করার সুযোগ নেই।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রথমে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) পরীমনিকে চার দিনের রিমান্ডে নেয়। এক দিন পরই সিআইডিকে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়। এ কারণে বাকি তিন দিন সিআইডির রিমান্ডে ছিলেন তিনি। এই একটি বিভাগ থেকে আরেকটি বিভাগে স্থানান্তরপ্রক্রিয়ায় কিছুটা ঝামেলা হয়। তিনি বলেন, সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে পরীমনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। কিছু ব্যক্তির নাম বলেছিলেন, যাঁদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। যাঁরা মাদক সরবরাহ করতেন। এই তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং আরো গ্রেপ্তার আসামিদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ আগস্ট আবার রিমান্ডের আবেদন করে সিআইডি। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ সময় আদালত বলেন, কারা জড়িত তাঁদের নামের তালিকা তো দেয়নি সিআইডি। অথচ আদালত আদেশে বলেছেন, যৌক্তিক কারণে রিমান্ড মঞ্জুর করলাম।
জবাবে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তদন্ত সংস্থা তদন্তের স্বার্থে অনেক তথ্য প্রকাশ করতে পারে না, যা রেকর্ডে থাকে। তিনি বলেন, দ্বিতীয়বার দুই দিন রিমান্ডে নেওয়ার পর এই অভিযুক্ত তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই সুচতুর কৌশলে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। তিনি সমাজের কিছু লোকের নাম বলেছেন। এসব যাচাই-বাছাই করতেই সিআইডি তৃতীয় দফা রিমান্ডের আবেদন করে। আদালত ১৯ আগস্ট এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। যখন একজন আসামি এ রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন, তখন আইনগতভাবে এটা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এ ছাড়া তাঁকে নির্যাতন করারও কোনো অভিযোগ করেনি আবেদনকারীপক্ষ। তিনি বলেন, আদালত দেখবেন সিডিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য আছে।
এরপর আবেদনকারীপক্ষে অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে পরীমনিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশনা মেনে তাঁকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারত। কারাফটকের বাইরে জিজ্ঞাসাবাদের এখতিয়ার নেই। জোর কের কিছু আদায় করার সুযোগ নেই। এটা শুধুই আদালত অবমাননা নয়, মানবাধিকার পরিপন্থীও বটে। এটা ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমল নয়। এ সময় আদালত তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে আইনগত যুক্তি তুলে ধরতে বলেন। আদালত বলেন, পরীমনিকে কি কোনো নির্যাতন করা হয়েছে? জবাবে জেড আই খান পান্না বলেন, শারীরিকভাবে নির্যাতন করাটাই শুধু নির্যাতন না। মানসিক নির্যাতনও একটা নির্যাতন। তাঁকে যেভাবে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটাও নির্যাতন। এখানে গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়নি।
পরীমনিকে তিন দফা রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা চেয়ে গত ২৯ আগস্ট আবেদন করে মানবাধিকার সংগঠন আসক। আবেদনে এই রিমান্ড মঞ্জুর করা ও রিমান্ডের আবেদন করার কারণে সংশ্লিষ্ট মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ ও র্যাবের প্রতি কারণ দর্শাতে রুল জারির আরজি জানান।
গত ২৬ আগস্ট একই হাইকোর্ট বেঞ্চ পরীমনির জামিন প্রশ্নে রুল জারি করে আদেশ দেন। ১ সেপ্টেম্বর রুলের ওপর শুনানির দিন ধার্য করা হয়। এই রুল বিচারাধীন থাকাবস্থায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ৩১ আগস্ট পরীমনির জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এর পরদিন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
গত ৪ আগস্ট বনানীর বাসা থেকে পরীমনি ও তাঁর সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দিপুকে আটক করে র্যাব। এ সময় তাঁর বাসা থেকে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়। পরদিন সহযোগীসহ তাঁর বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করা হয়।