মো. শিমুল হাছান:
ফরিদগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত সেই জিএফএল (জনকল্যাণ সমিতি)-এর এক মালিক, প্রতিষ্ঠানেরই প্রকল্প পরিচালক শাহাজান বেপারী আটকের পর তার প্রতারণার বিভিন্ন তথ্য বেরিয়ে আসছে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করতেন মোবাইল ফোনের ২২টি সিম। বিভিন্ন থানায় শাহাজানের বিরুদ্ধে দায়ের করা তিনটি পৃথক মামলায় তিনটি গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে পুলিশের হাতে। প্রায় ১২০ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় থাকা সত্ত্বেও শাহাজান বেপারীর প্রতারণার কারণে আজ প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। এতে করে প্রায় ৫ হাজার আমানতকারী তাদের প্রাপ্য টাকা কীভাবে আদায় হবে সে নিয়ে হা-হুতাশ করছে দীর্ঘদিন যাবৎ। গত ৭ ডিসেম্বর শাহাজান বেপারী আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে জামিন না দিয়ে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়।
আসামী শাহাজানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার পক্ষ নিয়ে তার জামিন চেয়ে আইনজীবী হিসেবে উচ্চ আদালত থেকে এসেছিলেন অ্যাডঃ নূর হোসেন বলাই। অপরদিকে বাদী জিএফএল-এর আরেক পরিচালক মিজানুর রহমান আরজুর দায়ের করা মামলা পরিচালনা করছেন অ্যাডঃ বদিউজ্জামান কিরণ।
সূত্র জানায়, শাহাজানের ভদ্রবেশী চেহারার অন্তরালে তিনি ছিলেন অত্যন্ত চতুর ও বিশ্বাসঘাতক। আমানতকারীদের টাকায় কৌশলে স্ত্রীর নামে সম্পদ গড়েও ক্ষান্ত হননি। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আইডি কার্ডে নিজের ছবি পাল্টিয়ে অন্যের ছবি ব্যবহার করে শাহাজান বেপারী মোট মোবাইল ফোনের ২২টি সিম ব্যবহার করতেন। শুধু তাই নয়, ভোলা, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকায় বিভিন্ন প্রতারণার কারণে এখনও তার বিরুদ্ধে ৩টি মামলার ওয়ারেন্ট বহাল রয়েছে বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিশ্চিত করেছে।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা যায়, ফরিদগঞ্জ উপজেলার কেরোয়া গ্রামের আবদুল লতিফ বেপারীর ছেলে শাহাজান বেপারী। এক সময়ে অভাব-অনটনের কারণে মাত্র ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন তিনি। তারপর ঢাকায় একটি ওয়ার্কশপে শ্রমিকের চাকুরি করতেন। পরে ফরিদগঞ্জ বাজারে এসে নিজেই একটি ওয়ার্কশপ চালু করেন। যে দোকানটি তিনি ভাড়া নেন সেই দোকানের ৩ বছরের কাগজকে ৩০ বছর বানিয়ে নেন। বহু দেন-দরবার করে মালিক আমির হোসেন পাটওয়ারী তাকে দোকান থেকে বের করে দেন। তারপর ফরিদগঞ্জের ৪ ব্যবসায়ী আলকায়েদ, মোঃ আরজু, মোরশেদ পাটওয়ারী ও মাহাবুবুর রহমানের সাথে সখ্যতা তৈরি করে ২০০৪ সালে জিএফএল নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার পর চতুর শাহাজান বেপারী বিভিন্ন সময় নানা প্রতারণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে জমা দেয়া আমানতকারীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এক পর্যায়ে আমানতকারীদের প্রাপ্য টাকা না দিতে পেরে সেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। নিরূপায় হয়ে উক্ত প্রতিষ্ঠানটির ৪ মালিক বিভিন্ন সময় শাহাজান বেপারীর সাথে হিসাব-নিকাশ নিয়ে একাধিকবার দেন-দরবার করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তাই প্রতিকার চেয়ে শাহাজান বেপারীর বিরুদ্ধে ওই ৪ মালিক জেলা সমবায় কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দেন। এই অভিযোগ দায়েরের পর বিভিন্ন তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যমতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ক্যাশ বইতে লিপিবদ্ধ না করে শাহাজান বেপারী জিএফএল-এর আমানতকারীদের মোট ৩৪ কোটি ৮০ লাখ ১০২৯ টাকা আত্মসাৎ করেন। আমানতকারীদের অর্থ ফেরৎ পেতে বাকি ওই ৪ মালিক একজোট হয়ে শাহাজান বেপারী ও তার স্ত্রী রাবেয়া বেগমের বিরুদ্ধে চাঁদপুরের আদালতে মামলা দায়ের করেন। উক্ত মামলা দায়েরের পর থেকে শাহাজানকে বহু খোঁজাখুঁজি করেও পুলিশ আটক করতে পারেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহাজান বেপারী আমানতকারীদের টাকায় চাঁদপুর সদরের খলিশাডুলী এলাকায় একটি ছয় তলা বাড়ি নির্মাণ করেন। সেই বাড়ি কৌশলে তার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করে দেন। ঢাকার সাভারে মূল্যবান সাড়ে ৬ শতক ভূমি তাদের পাঁচ জনের নামে ছিল। ঐ ভূমি বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা পরিশোধের জন্য সমিতির ক্যশিয়ার শামছুদ্দিনের নামে পাওয়ার রেজিস্ট্রি করে দেন। কিন্তু শাহাজান বেপারী সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাশিয়ারকে ম্যানেজ করে মূল্যবান ভূমি শাহাজানের স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়ে যান।
উক্ত প্রতিষ্ঠানে সাড়ে তিন লাখ টাকা আমানত রাখা ফরিদগঞ্জের সাহেবগঞ্জ গ্রামের এক সিএনজি চালক মোস্তফা বলেন, আমি বিদেশে থাকার সময় আমার স্ত্রীর মাধ্যমে ওই টাকা জমা দিয়েছি। এখন লাভতো দূরের কথা, আমার কষ্টার্জিত সেই টাকা পেতে বহুবার ধর্ণা দিয়েছি। এক সময় তারা সবাই উধাও হয়ে যান। একই কথা বলেন আরেক আমানতকারী আনিছুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রায় ৫ হাজার আমানতকারী রয়েছে যারা এই প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা পাবে। ১২০ কোটি টাকার জিএফএল প্রতিষ্ঠানটি এখন তালাবদ্ধ। কেরোয়া গ্রামে তাদের গড়া একটি ৫ তলা ভবন ইসলামী ব্যাংকে দেনার দায়ে নিলাম দেয়ার জন্য সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে চাঁদপুর শহরে শাহাজানের বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীকে পাওয়া যায়নি। সেই ভবনটির তিন তলায় বসবাস করেন শাহাজানের ঘনিষ্ঠজন। বাসায় গিয়ে দেখা যায় টাইলস্ করা রুমে আলিশান সোফা আর বিভিন্ন দামী আসবাবপত্রে ভরপুর। রুমের দরজা খুলতে বললে আয়েশা নামে এক শিশু কন্যা জানান, এই বাসায় কেউ নেই। বর্তমানে শাহাজান বিভিন্ন প্রতারণার কাজে তাকে ব্যবহার করেন।
জিএফএল-এর চেয়ারম্যান আলকায়েদ বলেন, মাত্র ৪র্থ শ্রেণী পাস করা শাহাজান তার ভদ্রবেশী চেহারার অন্তরালে আমাদেরকে কোনো কিছু না বুঝতে দিয়ে গোপনে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে প্রায় ১২০ কোটি টাকার প্রতিষ্ঠানটির পাঁজর ভেঙ্গে দিয়েছেন। যে কারণে যথাসময়ে আমরা গ্রাহকের টাকা না দিতে পেরে বিভিন্নভাবে অপমান-অপদস্থ হওয়া ছাড়াও আর্থিকভাবে বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখন পথে পথে হাঁটছি। একই বক্তব্য দেন জিএফএল-এর আরেক পরিচালক শাহাজানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী মিজানুর রহমান আরজু।
ভুক্তভোগী প্রায় ৫ হাজার আমানতকারীর কোটি কোটি টাকা আদায়ের স্বার্থে অভিযুক্ত শাহাজান যাতে করে আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে সেজন্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করছেন আমানতকারীরা।