প্রতিনিধি
ব্যস্ততম সড়ক ফরিদগঞ্জ-চাঁদপুর সড়ক। কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলছে এ সড়কে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। গাড়ি চালকদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ সকল রসিদধারী চাঁদাবাজরা। এক একটি স্টেশন অতিক্রম করলেই লাঠি হাতে গাড়ির গতি রোধ করে দু একজন যুবক। চালকদের হাতে লাল বা নীল রঙের একটি রসিদ ধরিয়ে দিয়েই তুলে নেয় ১০/১৫ টাকা করে। টাকা না দিলে চালকদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল অতঃপর হাতের লাঠি দিয়ে গাড়িতে আঘাত করা নিত্য নৈমিত্তিক একটি বিষয়। চাঁদপুর সদর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় এ ঘটনা ঘটে আসছে দীর্ঘ ৮-১০ বছর। রসিদধারী এ চাঁদাবাজদের ভদ্র নাম লাইনম্যান হলেও এদের মধ্যে অধিকাংশই বেলাইনের লোক। সরজমিনে গিয়ে দেখা করলে এ লাইনম্যানদের অনেকেই দেখাতে পারেননি তাদের টাকা উত্তোলনের পারমিশন কার্ড। চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ পৌরসভার ট্যাক্স আদায়কারী দু’ তিন জন যুবক ছাড়া বাকিরা প্রত্যেকেই চাঁদা তুলছেন ক্ষমতার দাপটে। দীর্ঘদিন ধরে এরা চাঁদা তুলে আসছে চাঁদপুর ওয়্যারলেস মোড়ে চাঁদপুর জেলা সিএনজি অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন ও চাঁদপুর জেলা অটো টেম্পু ও অটো মালিক সমিতি সংগঠনের নামে। ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডসহ আরও ৩টি স্থানে চাঁদা তোলা হচ্ছে ‘ফরিদগঞ্জ উপজেলা সিএনজি, অটোরিক্সা, টেম্পু শ্রমিক ইউনিয়ন’ সংগঠনের নামে। প্রতিদিনকার শ্রমিক উন্নয়নের নামে তোলা এ অর্থ কোথায় যাচ্ছে তা জানেন না সাধারণ চালকরা। বছরের পর বছর এ অর্থগুলো চলে যাচ্ছে অদৃশ্য শক্তির হাতে।
জানা যায়, প্রতিদিন যে অর্থগুলো তোলা হয় তার অর্ধেক যায় নাম না জানা সেই রাঘব বোয়লদের হাতে আর বাকি অর্ধেক যায় যারা চাঁদা কালেকশান করে তাদের পকেটে। সরকার আসে সরকার যায় দেশের প্রেক্ষাপট পাল্টায়, কিন্তু বছরের পর বছর এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট চক্র থাকে সক্রিয়। গরিবের পেটে লাথি মেরে এ অর্থগুলো যারা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা বরাবরই রয়ে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে। ‘ফরিদগঞ্জ উপজেলা সিএনজি, অটোরিক্সা, টেম্পু শ্রমিক ইউনিয়ন’ সংগঠনটি কে বা কারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তা জানেন না ফরিদগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডের সাধারণ সিএনজি স্কুটার চালকরা। কবে কোথায় এ সংগঠনের নির্বাচন হয়েছে কিংবা আদৌ এ সংগঠনের কোনো কর্মকর্তা আছেন কিনা তা জানা নেই তাদের। চালকরা শুধু চিনেন লাল/নীল রঙের একটি রসিদ! কিংবা নির্ধারিত স্থানের পরিচিত ক’জন যুবককে, যাদের হাতের লাঠির ইশারায় দিতে হচ্ছে দৈনন্দিন চাঁদা। গাড়িতে যাত্রী উঠুক আর নাই উঠুক তাদের গণ্ডি অতিক্রম করলেই দিতে হবে নির্ধারিত ট্যাক্স(!) এ সড়কের এমন চাঁদাবাজির জন্যই ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে ফরিদগঞ্জ-চাঁদপুর সড়কের সিএনজি অটোরিক্সার যাতায়াত ভাড়া। মাত্র ১০/১২ কি.মি. পথের জন্য আদায় করা হচ্ছে ৪০/৫০ টাকা। যে কোনো সিএনজি অটোরিক্সা চালক গাড়ি নিয়ে বের হলেই ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে দিতে হচ্ছে ৩০ টাকা, চাঁদপুর সেতুতে টোল দিতে হয় ১৫ টাকা, চাঁদপুর ওয়্যারলেস মোড়ে ৩০ টাকা সবমলিয়ে প্রতিদিন ৭৫ টাকা করে দিতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। এর মধ্যে চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ পৌরসভা ১০ টাকা করে ২০ টাকা আদায় করলেও বাকি অর্থ কে বা কারা নিচ্ছে তা অজানা গাড়ি চালকদের। শ্রমিক ইউনিয়ন বা শ্রমিক মালিক সমিতির নামে এ অর্থগুলো তোলা হলেও কোনো শ্রমিক বিপদে পড়লে বা কোনো সিএনজি অটোরিক্সা দুর্ঘটনায় পড়লে তাদের পাশে থাকছেন না এ সংগঠনগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। বরং নিজেদের অর্থ দিয়েই নিজেরা ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে সিএনজি অটোরিক্সা ও দুর্ঘটনা কবলিত যাত্রীদের। গাড়ি চালকদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের এ বিষয়গুলো যেনো দেখেও দেখছেন না সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠনের নামে আদায়কৃত এ অর্থ কোথায় যাচ্ছে এ বিষয়ে স্থানীয় চাঁদা আদায়কারী কয়েকজনের সাথে আলাপ করলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক সিএনজি অটোরিক্সা চালক জানান, সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবুল খায়ের মেম্বারের হাত হয়েই এ টাকাগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে বন্টন হয়ে থাকে। এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলার আবুল খায়েরের সাথে মুঠোফোনে আলাপ করলে তিনি নিজেকে একজন শ্রমিক নেতা দাবি করে বলেন, বছর শেষে যে টাকা কালেকশন হয় তার মধ্যে অধিকাংশ টাকাই আমরা জেলা থেকে কমিটি আনতে ব্যয় হয়। বাকি টাকা থেকে অফিস ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক খরচ করে অবশিষ্ট টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হয়। রাঘব বোয়ালদের কোনো চাঁদা দিতে হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতীতে এ ধরনের সংগঠনগুলো যেভাবে দিয়ে এসেছে বর্তমানেও একইভাবে তা দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে ‘চাঁদপুর জেলা সিএনজি অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর সভাপতি মোঃ রিপন হোসেন বলেন, গাড়ি চালকদের অভিযোগের সাথে আমিও একমত। তাদেরকে যে সেবা দেয়ার কথা তা আমরা সঠিকভাবে দিতে পারছি না। অর্থনৈতিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, সারাদিন ৩টি স্থানে প্রায় ৫শ’ সিএনজি অটোরিক্সা থেকে ৫ হাজার টাকা কালেকশন হয়, যার মধ্যে আমাদের নিজস্ব অফিস ভাড়া, কিছু সংখ্যক পুলিশ ভাইদের চা-নাস্তার খরচ আর বাকি টাকা ডানে-বায়ে দিতে হয়। ডানে বায়ে বলতে মোঃ রিপন হোসেন কাদেরকে বুঝিয়েছেন এ বিষয়ে পুনরায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আপনারা বুঝে নিয়েন। যতদিন আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারবো ততদিন এই ডানে-বায়ের কাছে আমরা জিম্মি হয়ে থাকতে হবে। এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা অটোরিক্সা মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন জানান, আমাদের সংগঠনটি প্রতি মাসেই যে টাকা কালেকশন করে তার মধ্যে যৎ সামান্য যে টাকা ফান্ডে জমা হয় তা দিয়ে আমরা সংগঠন চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। কিছু টাকা প্রতি মাসেই আমাদের এদিক সেদিক দিতে হচ্ছে। যদি আমরা তা না দিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতাম তবে অবশ্যই চালক-শ্রমিকদের কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পারতাম।
এক পক্ষের দাবি তারা সেবা পাচ্ছে না অপরদিকে অন্যপক্ষের দাবি তার সাধ্যমতো সেবা দিয়ে আসছে। প্রকৃত সত্য যা-ই হোক না কেনো চাঁদা আদায়ের অজুহাতে ক্রমেই বেড়ে চলছে ব্যস্ততম এ সড়কটির যাতায়াত ভাড়া। যার ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের। পর্দার আড়ালে থাকা এ রাঘব বোয়ালদের চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট কয়েকটি সংগঠন রেখে নামে বেনামে সংগঠনগুলো বাতিল করে সাধারণ চালকদের দীর্ঘদিনের এমন ভোগান্তি দূর করতে এগিয়ে আসবেন সংশ্লিষ্টরা এমনটাই দাবি দরিদ্র সিএনজি অটোরিক্সার হাজারো চালকদের।