নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
চাঁদপুর সদর উপজেলার ৮নং বাগাদী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড হাজরা গ্রামের (সাহেব বাজার) নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধের দাবীতে মানবন্ধন ও গণ স্বাক্ষর পালন করেছেন নদী সিকিস্তি এলাকাবাসী। সোমবার ২৬ মার্চ এলাকার কয়েক শতাধিক কৃষক, শ্রমিক, জেলেসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নারী-পুরুষ মানববন্ধন ও গণস্বাক্ষরে অংশ নেয়।
সরোজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ২ হাজার মিটার এলাকা নিয়ে প্রতিদিনই ভাঙ্গছে ওই এলাকা। এ পর্যন্ত প্রায় আধা মাইলের বেশি ভেঙ্গে গেছে ফসলি জমি, ঘর বাড়ি সহ অনেক কিছু। প্রতিদিনই চিন্তায় থাকতে হয় ওই এলাকার সাধারণ মানুষের, কখন জানি ভেঙ্গে যায় তাদের শেষ সম্বল বসত ঘরটুকু। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নদী ঢুকে পরেছে স্থায়ী বাড়ির ভিতরে। ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় দুটি উচ্চ বিদ্যালয় (ডি.বি উচ্চ বিদ্যালয়, জনতা উচ্চ বিদ্যালয়), একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় (৭২নং পশ্চিম সকদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়), একটি কিন্ডার গার্টেন, দুটি মসজিদ, ১টি মাদ্রাসা (হাজরা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা), কবর স্থান সহ সাহেব বাজরের প্রায় দু’শতাধিক দোকান পাট ও দুটি স’মিল এবং দেড় শতাধিক বসত ঘর রয়েছে। এ ভাঙ্গন কবলিত এলাকা নিয়ে এর পূর্বেও স্থানীয় বেশ কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী জানায়, প্রায় ৩-৪ মাস যাবত নদী ভাঙ্গন বেশি শুরু হয়েছে। আমাদেরকে দেখার যেন কেউ নেই। প্রায় আধা মাইলের বেশি ফসলি জমি ও বসত ভিটা ভেঙ্গে গেছে। আমরা নদী পাড়ের মানুষ। আমাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায় কৃষি কাজের উপর। ভেঙ্গে যাওয়া ফসলি জমিতেই আমরা কৃষি কাজ করেছি। এ ফসলি জমিতে ধান, আলু ও পাট চাষ করতাম। এখন এই জমিগুলো ভেঙ্গে যাওয়াতে আমরা প্রায় সর্বচ্ছ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। এখন আমাদের ফসলি জমি না থাকাতে গ্রামের অধিকাংশ মানুষগুলো দিনমজুর সহ বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালাচ্ছে।
ভাঙ্গন এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আলী আহমেদ (৭৫), শাফিয়া বেগম (৮০), মনির হোসেন গাজী (৪৫), বশির উল্যাহ মিজি (৬৫), আজহার কাজী (৫৫), ছানাউল্যাহ গাজী (৫০), রানু বেগম (৬৫), আনোয়ারা খাতুন (৮৫) সহ অনেকেই জানান, চলমান শুষ্ক মৌসুমে যে ভাবে নদী ভাঙ্গন শুরু হয়েছে এমন অবস্থা যদি বর্ষাকালে থাকে তাহলে এই এলাকায় একটি বাড়ি ঘরও থাকবেনা। সামনেই আসতেছে কাল বৈশাখী ঝড়, এরপর শুরু হবে বর্ষকাল। তাই এর মধ্যে যদি নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা না করা যায় তাহলে আমাদের সব শেষ হয়ে যাবে। আমরা পথে নামা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। প্রত্যেক ইউপি নির্বাচন এলেই চেয়ারম্যান মেম্বাররা বলেন, পাশ করলে আপনাদের এ নদী ভাঙ্গনের সমস্যা সমাধান করবো। কিন্তু পাশ করার পর আর কেউ আমাদের খোজ খবর রাখে না। কিন্তিু অদ্যবদী পর্যন্ত কোন কুলকিনারাই পেলাম না আমরা।
এলাকার রাবেয়া বেগম (৭৫) জানায়, আমার দিনতো প্রায় শেষ অবস্থা, চোখেও কম দেখি ও কানেও কম শুনি, আমিতো চলেই যাবো। কিন্তু আমার ছেলে ও নাতি নাতনিদের নিয়ে অনেক ভয়ে আছি। তাদের এই শেষ সম্ভলটুকু যদি আল্লাহ তায়ালা রক্ষা না করেন তাহলে তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। তবে কারো না কারো উছিলায় আমাদের নদী ভাঙ্গন যদি বন্ধ করা যায় তাহলে আমরা রক্ষা পাবো। নির্বাচনের আগে আমার মা এমপি ডাঃ দীপু মণি আমাদের এই জায়গায় এসে আমাদেরকে বলেছেন এ নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে অবশ্যই ব্যাবস্থা গ্রহন করবেন। কিন্তু সেদিনই তার সাথে দেখা হইছে। এরপর আর তাকে দিখেওনা এবং ভাঙ্গন বন্দেও কোন ব্যবস্থা দেখছিনা।
পাশ্চিম সকদি ডি.বি. উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক সদস্য মহসিন মিজি জানান, এ নদী ভাঙ্গন বন্ধের জন্য বহু দৌড়ঝাপ দিয়েছি, কারণ এই হাজেরা গ্রাম আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি ও আমাদের অনেক মুরব্বিরা এলাকার কবরস্থানে শুয়ে আছেন। নদী এ ভাবে ভাঙ্গতে থাকলে একসময় আমাদের এই কবর স্থান নদীর গর্ভে চলে যাবে। মূলত এ নদী ভাঙ্গনের কারণ হলো ৬৪ মাইল নানীপুর বেরি পাম্প হাউজের পানির টানেই এ ভাঙ্গন দেখা দেয়। পাম্প যখন পানি টানে তখন এদিক দিয়ে অনেক ¯্রােত হয়। এতে মাটির নিচের অংশ ফাকা হয়ে যায়, তাতেই মাটিগুলো ভেঙ্গে নদীতে পরে। অতিতে একবার আমাদের এ হাজরা গ্রামের নদী ভাঙ্গন বন্ধের জন্য অনুদান এসেছে। কিন্তু পরবর্তীতে এ অনুদানের টাকা কি কারনে ফেরৎ চলে যায় তা আমার জানা নেই। আমি বিষয়টি জানার বহু জায়গায় গিয়েছি এবং অনুদানটি ফিরিয়ে আনার জন্য বহু চেষ্ঠা ও তদবীর করেছিলাম, তাতেও কোন কিছু হচ্ছে না। কোথায় তদবীর করলে আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যাটি সমাধান হবে তা সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
সাহেব বাজারের ব্যবসায়ি মোঃ সুমন পাটওয়ারী জানান, এ নদী ভাঙ্গনের কারনে এলাকার মানুষ ভিটা মাটি হারা হয়ে পরছে। আমাদের এ বাজারটিও প্রায় ভাঙ্গন কবলে চলে আসছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নিলে এলাকাবাসী ও এ বাজারের দোকনাদরার উপকৃত হবে।
এলাকার মোঃ জাকির হোসেন জানান, আমার নানার বাড়িতে আমার শৈশব কাল কেটেছে। এখান থেকেই পড়াশুনা করে বড় হয়েছি। আমার দেখা এই নদী ভাঙ্গন এলাকাটি দিনের পর দিন মানুষের বসত ভিটা ভেঙ্গে বিলিন হয়ে নদীর গর্ভে চলে যাচ্ছে। এতে এলাকাবাসী সর্বহারা হয়ে পড়ছে। অনেক লোকজন বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এ ভাঙ্গনের কারনে এলাকাটি অর্থনিতিতে দূর্বল হচ্ছে।
এলাকার ইউপি সদস্য মনসুর আহমেদ খান (মনসু মেম্বার) জানান, মানুষ যে ভাবে ভিজা কাপড় চাপে ঠিক সে ভাবেই এ নদীটি হাজরা গ্রামবাসীকে চাপে। আমি প্রায় ২ বছর হলো মেম্বার হয়েছি। এ এলাকায় প্রায় ৫ থেকে ৬শ’ ভোটার আছে। আমার দেখা প্রায় আদা মাইলের বেশি ভেঙে গেছে। এখনও পর্যন্ত নদী ভাঙ্গনে কোন ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।
কিভাবে নদী ভাঙ্গন বন্ধ করা যায় এম প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বর্তমানে রিং বাঁধ ব্লক দিয়ে এ পাড়টি বাঁধলে এই নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পাবে এলাকাবাসী।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকোশলী মোঃ আবু রায়হান জানান, বাংলাদেশে দুইটি বাজেট হয়। একটি হলো উন্নয়ন রাজর্স বাজেট, আর দ্বিতীয়টি হলো অনুউন্নয়ন বাজেট। আমাকে যদি কোন বাজেট না দেওয়া হয়, তাহলে কাজ করা সম্ভব না। যে কোন ভাঙ্গনে প্রথম এলাকায় প্রকল্প প্রনয়ন করে। পরে একনেক কর্তৃক অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার দির্ঘ সময়ের বেপার ফলে ভাঙ্গন বৃদ্ধি পায় এবং জনগণ দূর্ভোগের সম্মক্ষিন হয়। দ্রুত যদি ভাঙ্গন ঠেকাতে অনুউন্নয়ন রাজস্ব খাত হতে বরাদ্ধ প্রদান করা হলে কাজ অল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডে অনুউন্নয়ন রাজস্ব খাতে বাজেট বরাদ্ধ বৃদ্ধি করলে এ রকম ভাঙ্গন এলাকগুলো খুব ভালো ভাবে রোধ করা সম্ভব। তবে এলাকাবাসীর উদ্যোগে তাৎক্ষনিক ভাঙ্গন কবলিত এলাকা বাঁশ বলি এবং বালু ভর্তি বস্তা (চিলিক বস্তা) দিয়ে আপদত নদী ভাঙ্গন রোধ করতে পারে।
চাঁদপুর ৩ আসনের সফল এমপি ডাঃ দীপু মণি সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভাঙ্গন রক্ষায় জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবী জানান হাজরা গ্রামের ৩ হাজার বাসিন্দা।