নাম তার লুৎফর রহমান। বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানার চর ভরুয়া গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই লুত্ফর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। পরে গোপালপুর পিংনা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এসএসসি ও ১৯৭৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। এর আগে ৭৬ সালে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। চাকরিরত অবস্থাতেই ৮০ সালে স্নাতক পাশ করেন পোপালপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে। পরের বছরই তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। গ্রাম্য সাদাসিদা ও ধর্মপরায়ন যুবকটি এরপরই বদলে যেতে থাকেন। ঢাকায় আসেন। ৮৯ সালে যোগ দেন ঈগল কোম্পানিতে। দু’বছর পর চাকরী পরিবর্তন করে যোগ দেন মেটলার কোম্পানিতে। সেখানে প্রায় ৮ বছর কাজ করেছেন বলে পরিবার সদস্যরা জানিয়েছেন। কর্মজীবনে বৈচিত্রের পাশপাশি লুত্ফর মূলত সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে ফিরে বিচিত্র আচরণ শুরু করেন। মনোনিবেশ করেন ভিন্ন ধারার ধর্ম সাধনায়।
ঢাকায় অবস্থান করে চাকরিরত অবস্থাতেই লুৎফর গ্রামে গিয়ে বলতেন তিনি ইমাম মাহদীর দেখা পেয়েছেন। রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় ইমাম মাহদীর জন্ম হয়েছিল এবং তিনি মারাও গেছেন বলে প্রচার করতে থাকেন। তার প্রধান সেনাপতি মনসুরের দায়িত্ব পেয়েছেন লুত্ফর রহমান। সময় পরিক্রমায় ১৯৯৭ সাল থেকে মৌখিকভাবে তিনি হিজবুল মাহদী বা ইমাম মাহদীর দলের প্রচার শুরু করেন। এ বছর গ্রামবাসী তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। ধর্মের বিকৃত প্রচারনার দায়ে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর ঢাকায় অবস্থান করে ৯৯ সাল থেকে লুৎফর রহমান লিফলেট বিতরণসহ লিখিতভাবে হিজবুল মাহদী নামের সংগঠনের জন্য প্রচার শুরু করেন। তখন কিছু লোকজন তার মুরিদ হলেও তা ছিল হাতেগোনা।
২ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক লুত্ফর তার সন্তানদের নামের সঙ্গে অজ্ঞাত কারনে জুড়ে দেন ফারুক, যা তার নিজের নামের সঙ্গেও যুক্ত। বড় ছেলে সারোয়র উল ইসলাম ফারুক ও মেয়ে শামসুন্নাহার ফারুক পড়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক পড়েছেন নটরডেম কলেজে। সন্তানদেরকেও তিনি নিজ আর্দেশর অনুসারী করে কাছে রাখতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সন্তানদের তিনি ইমাম মাহদীর আদর্শ প্রচারের জন্য বলতেন।
আব্দুল্লাহ আল ফারুক কালের কণ্ঠকে জানান, তার বাবা একটি গামেন্টে এসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) হিসেবে কাজ করতেন। কিছুদিন বায়িং হাউজের ব্যবসাও করেছেন। পরে তিনি সব ছেড়ে দেন এবং ৯৭ সাল থেকে ইমাম মাহাদীর ‘প্রধান সেনাপতি’ দাবি করে লেখালেখি করতে থাকেন। দাজ্জালের শিকল, আদী নূর ও শরীয়তে মাহাদীর কথা নামে তিনটি বই লিখেছেন। বিভিন্ন জনের কাছে মতাদর্শ বিষয়ে প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় যে চিঠি পাঠিয়েছেন সেগুলো নিয়ে একটি বই বের হয়। এ মতাদর্শ প্রচারের কারনেই বাবা খুন হয়েছেন বলে তিনি মনে করেন।
পুলিশ ও পরিবার সদস্যদের মাধ্যমে জানা গেছে, ঢাকায় অবস্থানকালে লুত্ফর রহমান সূত্রাপুর থানার দীননাথ সেন রোডের সাধনার গলিতে বাসা ভাড়া নিয়ে ‘হিজবুল মাহদী’ নামের সংগঠনের কাজ করতে থাকলে এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তখন লুত্ফরের সমর্থকরা আল্লাহকে ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করতে প্ররোচিত করছিলেন। গোটা বিশেষ ভক্ত নিয়ে নিজ বাসায় নামাজ আদায় এবং জিকির করতেন তিনি। লুত্ফর রহমান ফারুক তার ভক্তদের বলতেন, ‘দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত হাজার হাজার মাদ্রাসার নামে হাইওয়ান দাজ্জাল তৈরির কারখানা আছে। ইমাম মাহদীকে গ্রহণ না করে কেউ ইমান নিয়ে মরতে পারবে না।’
২০০৭ সালে সূত্রাপুর এলাকায় এ কর্মকাণ্ডের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তখন বেশ কিছুদিন জেল খাটেন তিনি। জেল থেকে বেরিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আস্তানা গড়ে একই কর্মকাণ্ড চালাতে থাকেন। পরে এলাকার লোকজন তাকে গণধোলাই দিয়ে বের করে দেয়। এরপর তিনি গোপীবাগে বাসা নিয়ে একই কাজ করতে থাকেন। ২০০৫ সালে যাত্রাবাড়ী বিবির বাগিচার বাসায়ও হামলা হয়েছিল। কখনো নিজেকে ‘ইমাম মাহদী’ আবার কখনও মাহদীর সেনাপতি পরিচয় দিয়ে লুত্ফর রহমান ফারুক বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির রোষানলে পড়েন। তারই ধারাবাহিকতায় দু’দফা গণপিটুনি ও হামলার শিকার হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন চারবার। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা ও জিডি রয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৪ অক্টোবর গোপীবাগ ১ম লেনের একটি বাড়ি থেকে লুৎফর রহমান ফারুককে ৫ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। শনিবার নিহত হওয়া মুরিদ মনির ও শাহীনও সে সময় গ্রেপ্তার হয়েছিল।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিজেকে হযরত ইমাম মাহদী (আ.), আবার ইমাম মাহদীকে (আ.) নবী দাবি করে তার প্রধান সেনাপতি হিসেবে পরিচয় দেয়া, ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধমপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে দুই ওয়াক্ত নামাজ, নতুন কালেমা ‘আব্বা আল্লাহ ইমাম মাহদী হুজ্জাতুল্লা’ প্রচারসহ নানা অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন তার বিরুদ্ধে নানা সময় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে। এ অবস্থায় লুত্ফর রহমানসহ ৬ খুনের নেপথ্যে পুরনো এ সকল বিরোধ কাজ করতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
ভক্তদের কাছে ‘আব্বা হুজুর’ নামে পরিচিত লুত্ফর ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে নানা অভিনব পন্থার কথা প্রচার করতেন। তিনি নামাজ পড়েন মাত্র দু ওয়াক্ত। সকাল ৬টায়, সন্ধ্যায় এবং তাহাজ্জুতের সময়। ঈদের নামাজ কিংবা জু’মার নামাজ পড়তেন না তিনি। কিন্তু সপ্তাহে শুক্রবার এবং সোমবার মজমা আকারে নামাজ পড়তেন। মুখোমুখি বসে ইমামতী করতেন।
লুৎফরের ছেলে আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারীরা জানান, ফজরের ও মাগরীবের সময় নামাজ পড়তেন আব্বা। সেখানে কোন রুকু, সিজদা দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। তারা নামাজে হাটু গেড়ে বসে ধ্যান ও জিকির করতেন। জিকিরে তারা ‘আব্বা আল্লাহ’ বলতেন বিভিন্ন সুর করে। এটি চলত প্রায় ১৫-২০ মিনিট। এটাই ছিল তাদের নামাজ। ঈশ্বরের উদ্দেশেই আব্বা শব্দটি ব্যবহার হত।
রোজা রাখার নিয়ম সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বলেন, সকাল আটটার আগে তারা সেহারী খেতেন। অর্থাৎ অন্য দিনের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ খাবার খেয়ে। মাগরিবের আজানের আগে যদি কারো ক্ষুধা লাগলে ১০০ গ্রাম মুড়ি বা ২টি বিস্কুট খেয়ে পানি খেতেন। রোজার এক মাস তারা মাছ ও মাংস জাতীয় খাবার পরিহার করতেন।
শিরোনাম:
বৃহস্পতিবার , ২৭ মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১৩ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।