প্রবীর চক্রবর্তী
এককালের প্রমত্তা ডাকাতিয়া কালের আবর্তে আজ মরা ডাকাতিয়া নদীতে পরিণত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে চাঁদপুর জেলার চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ, হাইমচর, লক্ষ্মীপুর জেলার লক্ষ্মীপুর সদর, রামগঞ্জ এবং রায়পুরের কিয়দংশ নিয়ে প্রায় ১শ’ কিলেমিটার এলাকা নিয়ে শুরু হওয়া ৫৭ হাজার হেক্টর জমিকে বন্যামুক্ত রেখে বছরে একাধিক ফসল ও মাছ উৎপাদনের জন্য চাঁদপুর সেচ প্রকল্প নামে ওই সময়ে ৫৪.৩০ কোটি ব্যয়ে এই প্রকল্পটি ১৯৭৮ সালে সম্পন্ন হয়। এরপর বস্তুত প্রমত্তা ডাকাতিয়া তার গতি ও স্রোত হারিয়ে ফেলে। কালের বিবর্তনে ফরিদগঞ্জ উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাকাতিয়া দখল, নব্যতা সঙ্কট এবং কচুরিপানা জটের কারণে নদীটি মৃতপ্রায় অবস্থায় পৌঁছেছে। এর সাথে গত এক দশক ধরে নদী থেকে ইচ্ছে মতো অবৈধ ড্রেজিং ও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের মাধ্যমে কিছু কিছু লোক লক্ষপতি হয়ে গেলেও ডাকাতিয়া নদী ক্রমশঃ খালে পরিণত হয়েছে। শুস্ক মৌসুমে এটি প্রায় পানি শূন্য ও কচুরিপানার কারণে দুর্গন্ধ ও ব্যবহার উপযোগী হয়ে পড়ায় এই নদীর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১০ হাজার জেলে পরিবারকে অনেকটা বেকার জীবন কাটাতে হয়। এসব দুরাবস্থার কারণে ইতিমধ্যেই জেলে পরিবারের সদস্যরা তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে এবং এর সাথে সংযুক্ত খাল সমূহে সেচ প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত পানি যেতে না পারায় প্রতি বছরই উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সেচের পানির জন্য কৃষকরা ফসল ফলাতে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। চাঁদপুর সেচ প্রকল্প বাঁধ তৈরির পর বছরে স্থান ভেদে তিনটি ফসল কৃষকরা ঘরে তোলার পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছে মৎস্য খামার। গত ৪ দশকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা খাদ্যে স্বয়ং সম্পন্ন হওয়ার সাথে মাছে উৎপাদন করে আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নিঃস্ব থেকে স্বাবলম্বী হয়েছে অনেক মৎস্যজীবী। বর্তমানে ফরিদগঞ্জে কোটি কোটি টাকার মাছের চাষ হচ্ছে। এসব কিছুই মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায় ডাকাতিয়া নদীর কারণে। নাব্যতা সঙ্কটের কারণে বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানির পরিমাণ বাড়লেও দু’ কুল উপচিয়ে তা পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেত ও মাছের প্রজেক্টগুলোতে প্রবেশ করায় প্রায় বছরই মাছ চাষীদের লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবর্তিত হচ্ছে এলাকার জীব বৈচিত্র্য। অপরিকল্পিত বাড়ি ঘর নির্মাণ, খাল দখল, নদী দখলসহ নানা কারণে বন্যামুক্ত এলাকা ও সবুজে ঘেরা কৃষি প্রধান ফরিদগঞ্জ উপজেলা ক্রমশঃ হারাচ্ছে তার স্বকীয়তা। চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ নৌপথটি কচুরিপানা জটের কারণে বন্ধ হওয়ার পথে।
এসব কিছু বিবেচনা করে চাঁদপুর-৪ ফরিদগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়ার নির্দেশে স্থানীয় এলজিইডি ডাকাতিয়া নদী রক্ষায় ৪শ’ ৬৯ কোটি ৫ লাখ ৬২ হাজার ৯শ’ টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে। প্রকল্পে বলা হয় ডাকাতিয়া নদীর শাখা প্রশাখাসহ পুরো উপজেলা জুড়ে মাছের আবাদের কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু নদীটি সংস্কারের অভাবে মরে যাচ্ছে। কচুরিপানার কারণে স্বাভাবিক নৌ চলাচল করতে পারছে না। বিভিন্ন স্থানে রাস্তা ও জমি ভেঙ্গে পড়ছে। বাগান, জমি, নদী নালা মিলিয়ে সবুজের আবরণে ঢাকা পুরো উপজেলাটির ডাকাতিয়া নদী হলো প্রাণ। নৌপথে চাঁদপুর জেলা শহর ছাড়াও হাজীগঞ্জ ও পার্শ�বর্তী লক্ষ্মীপুর জেলার সাথে সংযোগ রয়েছে। নদীর ড্রেজিং করে বাঁধাই, রাস্তা করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্রিজ এবং দৃষ্টিনন্দন স্থানে অবকাঠামো তৈরি করলে পর্যটক আকৃষ্ট করার মতো একটি পরিবেশ সৃষ্টি হবে পুরো ডাকাতিয়া নদীর দু’পাড় জুড়ে। সে বিবেচনায় প্রকল্পে ৬০ কিঃমিঃ দৈর্ঘ্য ডাকাতিয়া নদীর উভয় পাড়ে বাঁধের মতো রাস্তা নির্মাণ, স্লোপ প্রটেকশন, বৃক্ষ রোপণ, কচুরিপানা পরিষ্কার, দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোগত নির্মাণ প্রাক্কলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পে কিলোমিটার প্রতি মাটির কাজে ৩৯ লাখ ১৯ হাজার ৬৬৩ টাকা, স্লোপ প্রটেকশন উভয় পাড়ের জন্য ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ৫৬ হাজার ২৮৮ টাকা, কচুরিপানা পরিষ্কারের জন্য ১০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা, বনায়নের জন্য ৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা, দু’ পাড়ে রাস্তা তৈরির কাজে ৫৩ লাখ ৯১ হাজার ৭৬৩ টাকা, সড়ক ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করণ ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা হিসেবে ৬০ কিলোমিটারে মোট ৪শ’ ৩৭ কোটি ৫ লাখ ৬২ হাজার ৯শ’ ৬০ টাকা এবং ৪টি ব্রিজ নির্মাণে ৩২ কোটি টাকা নিয়ে মোট ৪শ’ ৬৯ কোটি ৫ লাখ ৬২ হাজার ৯শ’ ৬০ টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটি তৈরির পর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবু সাহেদ সরকারের স্বাক্ষরযুক্ত ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া গত ১৭ সেপ্টেম্বর ডিও লেটারের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর অনুমোদন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রেরণ করেছেন। জানা গেছে প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ছাড়াও বন ও পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়েও জমা দেয়া হয়েছে।
প্রকল্প নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু তাহের জানান, ডাকাতিয়া নদীটিকে রক্ষা করার পাশাপাশি খালগুলো খননের মাধ্যমে নাব্যতা রাখতে পারলে ফরিদগঞ্জ উপজেলা নয় চাঁদপুর সেচ প্রকল্প এলাকায় ফসলের আবাদের ক্ষেত্রে কৃষকরা অনেক উপকৃত হবে।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবু সাহেদ সরকার প্রকল্প নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ডাকাতিয়া নদীকে রক্ষা করতে পারলে ফরিদগঞ্জ উপজেলার জীবন মান ও চালচিত্র পাল্টে যাবে।
সংসদ সদস্য ও চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া প্রকল্প সম্পর্কে জানান, এককালের প্রমত্তা ডাকাতিয়া নদী আজ মরা নদী। তাই এটিকে বাঁচাতে আমরা এই প্রকল্পটি তৈরি করে জমা দিয়েছি। বর্তমানে তা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি জানান, প্রকল্পটি সুন্দর এবং ভালভাবে সম্পন্ন করতে প্রয়োজনে তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনী কিংবা সেনাবাহিনীকে নিযুক্ত করে বৃহৎ এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশপাশি প্রকৃতিতে রক্ষা করতে পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ফরিদগঞ্জ উপজেলা উন্নয়নের সূঁতিকাগারে পরিণত হবে।