রমজানে তারাবি পড়বেন কোথায়?
করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আসন্ন রমজান মাসের তারাবি মসজিদে নাকি ঘরে পড়া হবে- এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।
করোনার কারণে ঝুঁকি এড়াতে জুমা, জামাতের মতো মসজিদের পরিবর্তে ঘরে তারাবি পড়ার বিষয়টি নিয়েও সরকার চিন্তাভাবনা করছে। সরকারিভাবে এমন নির্দেশনা আসতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকারের শীর্ষকর্তারা।
ধর্মমন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নুরুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তারাবির নামাজ বাসায় পড়তে হবে। এ অবস্থায় মসজিদে তারাবি হবে না। করোনা পরিস্থিতির কারণে মসজিদের পরিবর্তে মুসল্লিদের ঘরে নামাজ, জুমা আদায়ে সরকারি নির্দেশনা তো আছেই। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেটাই বহাল থাকবে। যেখানে জুমা-জামাত সীমিত করে মুসল্লিদের ঘরে নামাজ পড়তে বলা হয়েছে, সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারাবিও ঘরেই পড়তে হবে।’
দেশের শীর্ষ আলেমরা বলছেন, রোজার তারাবি সুন্নাত, আর সুন্নাত নামাজ মসজিদের পরিবর্তে ঘরে পড়া শরীয়ত সম্মত, উত্তম ও উচিত।
ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ বলেন, ‘‘তারাবির নামাজ সুন্নাত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে মুসল্লিদের মসজিদে তারাবি পড়া মোটেই উচিত হবে না। যেখানে সংক্রমণ এড়াতে জুমার জামাত করতে মুসল্লিদের নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে তারাবির মতো সুন্নাত নামাজ ঘরেই পড়া যেতে পারে।
‘মসজিদে তারাবি পড়তে হলে জমায়েত হবে, সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে। মূলত পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে আমাদের সবাইকে ঘরে নামাজ পড়তে হচ্ছে। এটা সবাই বোঝেন, সেটা মেনেও নিয়েছেন।”
দেশের বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুল অদুদ বলেন, ‘ইসলামী শরীয়তে মাকাসেদুশ শারিয়াহ বলা হয়, অর্থাৎ ইসলামী শরীয়তের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রথমে হিফজুননাস। আত্মরক্ষা করতে হবে। নিজের আত্মরক্ষা হলেই এবাদত বন্দেগি তথা আল্লাহকে ডাকতে পারবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আপাতত মসজিদে গিয়ে জমায়েত না করে তারাবি ঘরে পড়া ভাল। শরীয়ত মতেও সেটা জায়েজ।’
তিনি বলেন, ‘মানবতার বিপর্যয় আসবে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এটা ইসলামেও বলা আছে। যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তখন যেটা সবচাইতে উত্তম হবে সেটাই করতে হবে।’
‘রোজার আমলের সঙ্গে মসজিদের কোনো সম্পর্ক নেই, তারাবির নামাজ ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে জরুরি নয়’ মন্তব্য করে দেশের আরেক শীর্ষ আলেম ও ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতে মুসল্লিদের মসজিদের পরিবর্তে ঘরেই তারাবির নামাজ পড়া উত্তম। তাহলে প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে না। নিজে রক্ষা পাবে, অন্যরাও।’
তিনি বলেন, ‘শরীয়তের দৃষ্টিতে তারাবি মসজিদে জামাতে পড়া জরুরি না। বরং ঘরে পড়া বেশি সাওয়াবের। একা পড়তে পারলে আরো ভাল হয়। একসময় আমাদের অনেক জ্ঞানীগুণীর অভ্যাস ছিল স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মসজিদে জামাতে এশার ফরজ নামাজ শেষ করে বাসায় তারাবি পড়তেন। কিন্তু আমাদের যুগে অসুবিধা হলো ঘরে ঘরে কোরআনে হাফেজ নাই। কোরআন শরীফও আমরা ঠিকমত পড়তে পারি না। এ কারণে সবাই মসজিদে জামাতে নামাজ পড়তে চায়। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে মসজিদে যাওয়া ঠিক হবে না।’
বিশিষ্ট গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রফেসর ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মারুফ বলেন, ‘‘সারাবিশ্বে যেখানে জুমা, জামাত নিষেধ- সেখানে এ পরিস্থিতিতে তারাবি মসজিদে পড়া কখনই উচিত হবে না। বরং মূর্খরাই এখন মসজিদে যেতে চাইবেন। সবচাইতে ভাল হয় একা একা ঘরে তারাবি পড়া।
‘করোনার ঝুঁকি নেই বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে পরিবারের লোকজন নিয়ে ঘরে ছোট ছোট জামাত করা যায়। ঘরের ভেতরে যারা আছে তাদের তো আর দূরত্বের দরকার নেই। তারা তো একসঙ্গেই আছে। সুতরাং বাইরে না গিয়ে চাইলে ঘরেই ছোট জামাত করতে পারেন।”
ড. মারুফ বলেন, ‘‘মানুষ যেটা ভুল করে সেটা হলো- চোখের সামনে বিপদ না দেখা পর্যন্ত শিক্ষা নেয় না। চোখে না দেখা পর্যন্ত মনে করে তাদের কোনো বিপদ নাই। করোনার বিষয়টি এমন একটা অদৃশ্য প্রাণঘাতী শত্রু, যেটা চোখে দেখা যায় না। অথচ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এমন একটি মহামারী থেকে আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
‘বর্তমান অবস্থায় শুধু বাংলাদেশ নয়, মুসলিম বিশ্বের জ্ঞানীগুণী, আলেম ওলামা ও চিন্তাশীল লোকেরা মসজিদের পরিবর্তে ঘরে নামাজ পড়ার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, সেটি মেনে ঘরে তারাবির নামাজ পড়া উচিত।”
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আনিস মাহমুদ বলেন, ‘তারাবির নামাজ ঘরে নাকি মসজিদে পড়া হবে- এখনই সেটি বলার মতো পরিস্থিতি আসেনি। হাতে আরো দশ/বারো দিন সময় আছে। পরিস্থিতি পরিবেশ বিবেচনা করে এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করে যেটা কল্যাণকর সেই সিদ্ধান্তই নেব।’