দেশে আবারো লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ। রাজধানীতে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো জটিল রূপ ধারণ করছে। সারাদেশেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। তবে রাজধানীতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। গতকাল তিন জনসহ এ বছর ডেঙ্গুতে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০ হাজার ২৩৫ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১৭ হাজার ৭৫২ জন। গতকাল একদিনের পরিসংখ্যানে রেকর্ড ৭১২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। গত ৬ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়। এটি এ বছর একদিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ডেঙ্গু থাকবে সারা বছর। আগে মে-অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম ছিল। এখন সারা বছর ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া আগে ডেঙ্গু ছিল শহরকেন্দ্রিক, কিন্তু এখন সারাদেশে ডেঙ্গু রোগী। নিজেরা সচেতন না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এখন জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ওষুধ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বিলম্ব করে পরীক্ষা করা ও চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ার কারণে রোগী জটিলতা বাড়ছে। দিনের বেলায় মশারি টাঙানো, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ফুল হাতা জামা ও হাত-পায়ে মোজা পরারও পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি হওয়াদের মধ্যে ৪৯৯ জন ঢাকার বাসিন্দা। ঢাকার বাইরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১৩ জন। সবমিলিয়ে বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন এক হাজার ৮৩৮ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি আছেন ৫৭৮ জন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিজেরা সচেতন হতে হবে। কিন্তু অনেকই সচেতন নন। রাজধানীর অনেক বাড়ির পাশে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সেখানে নানাভাবে পানি জমে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার জন্ম হচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা ও ডাবের খোলে জমা পানিতেও জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা।
রাজধানী্র মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় ব্যাস্ত নার্স।—আব্দুল গনি
অন্যদিকে, বাসাবাড়িতে থাকা ফুল কিংবা গাছের টব থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে কিংবা আবাসিক এলাকায় উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। কিন্তু এডিস মশার প্রজনন রোধে নেই যথাযথ কোনো ব্যবস্থা। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব ময়লা-আবর্জনা সিটি কর্পোরেশন সরিয়ে নিচ্ছে না। মানুষও ময়লা ফেলা বন্ধ করছে না। ফলে দিন দিন বড় হচ্ছে স্তূপ। এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও তৈরি হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীন যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা রহমান বলেন, ‘প্রতিদিনই খবরে শুনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের অভিযান। কোথায় এ অভিযান? মশকনিধন কর্মীদের দেখাই তো মেলে না। বর্তমান অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রতি ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। তাহলে সিটি কর্পোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রম কি শুধু লোক দেখানো?
এদিকে দৈনিক শনাক্ত হওয়া ডেঙ্গু সংক্রমণ ছাড়িয়েছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যাকেও। এজন্য অনেকাংশেই রাজধানীতে চলমান নির্মাণকাজকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, প্রায় ৪০ শতাংশ এডিস মশার প্রজনন হচ্ছে নির্মাণাধীন বিভিন্ন প্রকল্প থেকে। নির্মাণাধীন ভবনের ক্ষেত্রে বেজমেন্টের (অট্টালিকার ভূগর্ভস্থ অংশ) কিউরিংয়ে বছরের পর বছর আটকে থাকা পানিতে এডিস মশার প্রজনন হয়। এসব মশা শুধু কর্মরত শ্রমিকদেরই নয়, আশপাশের বাসা-বাড়িতে থাকা মানুষদেরও কামড়ায়। তারাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ম মানা হচ্ছে না, কিন্তু তা যেন দেখার কেউ নেই। এক্ষেত্রে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। পাশাপাশি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-কেও এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে এগিয়ে আসতে হবে বলে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীরা প্রতিদিনই ভিড় করছেন ঢাকা মেডিকেল (ঢামেক) কলেজ হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। অনেকে হাসপাতালে সিট পাচ্ছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য সব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। পৃথক ইউনিট আছে। তবে এখন রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় ডাক্তারদের চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে নিজেদের সচেতন হতে হবে। বাসা-বাড়ি ও আশপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। একই সঙ্গে মশা নিধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। নির্মাণাধীন ভবন থেকে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এখন জ্বর হলে একদিন পরেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা করতে হবে। দ্রুত পরীক্ষা করে শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসা সেবা দিতে দ্রুত সুস্থ করা যাবে। তবে দেরিতে পরীক্ষা করলে রোগীর শারীরিক অবস্থা জটিল হতে পারে। এছাড়া একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত যারা হয়েছেন, তারা এখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জটিলতা দেখা দেবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে। কোনভাবেই এসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। বেশি করে পানি, ডাবের পানিসহ তরল জাতীয় ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নিজেরা সচেতন না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বাসা-বাড়ি ও আশপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। একই সঙ্গে মশা নিধন কার্যক্রম সারাবছর চালাতে হবে।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, আগে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতো মানুষ। কিন্তু এখন সারা বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে হলে ব্যক্তিগত সচেতনতা প্রয়োজন। ঘর-বাড়িসহ ডেঙ্গুর উৎসস্থল পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সিটি কর্পোরেশনকে সারা বছর মশা নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রত্যেক এলাকায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চালানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
- ডেঙ্গুর জ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু জ্বর এডিস মশার কারণে হয়। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কামড়ালে এই জ্বরের কবলে পড়তে হয়। জ্বর আসলে, তা ডেঙ্গু জ্বর কিনা তা বুঝতে কিছু উপসর্গের দিকে নজর দিতে হবে। যেমন- শরীরে শীতলতা অনুভব করা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, নিচের পিঠে ব্যথা, পেশি ব্যথা, হাড়ের সংযোগস্থানে ব্যথা, ফুসকুড়ি, ক্লান্তি, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ত্বক-চোখ লাল হওয়া। ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হওয়ার প্রথম কিছু ঘণ্টায় পায়ে ও হাড়ের সংযোগস্থানে ব্যথা অনুভব হয়ে থাকে। জ্বর খুব দ্রুত বেড়ে গিয়ে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হতে পারে। এসময় হৃদস্পন্দন হার ও রক্তচাপ কম থাকে। মুখমণ্ডলে লাল অথবা গোলাপী র্যাশ ওঠে, যা পরে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঘাড় ও কুঁচকির লসিকাগ্রন্থি প্রায়সময় ফুলে থাকে। বেশি মাত্রার জ্বর ও ডেঙ্গুর অন্যান্য লক্ষণ ২-৪ দিন থাকে, তারপর ঘাম ছেড়ে দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত হ্রাস পায়। দ্বিতীয়বার দ্রুত জ্বর বাড়ার আগে প্রায় একদিন শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে ও নিজেকে সুস্থ মনে হয়। পরবর্তীতে মুখমণ্ডল ব্যতীত সারা শরীরে চুলকানিযুক্ত ফুসকুড়ি ওঠে থাকে। হাতের তালু ও পায়ের তালু উজ্জ্বল লাল হতে পারে ও ফুলে যেতে পারে। কখনো কখনো ডেঙ্গু সংক্রমণ খুবই মারাত্মক অথবা প্রাণনাশক হয়ে থাকে। এটাকে বলে সিভিয়ার ডেঙ্গু। ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণের ৩-৭ দিন পর সিভিয়ার ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। যেসব লোক আগে ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের সিভিয়ার ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি। সিভিয়ার ডেঙ্গুর উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো- তীব্র পেট ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, রক্তবমি, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ, শ্বাসকার্য কঠিন বা দ্রুত হওয়া, শরীর ঠান্ডা অনুভব বা ঘাম হওয়া, দ্রুত নাড়ি স্পন্দন এবং ঘুম ঘুম ভাব/চেতনা হারানো। সিভিয়ার ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখলে এক মুহূর্তও দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে কিংবা হাসপাতালে যেতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্ণেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম ও অভিযান চলমান আছে। মশক নিধন অভিযানে আমাদের কর্মীরা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। সেগুলোও নিয়মিত মনিটর করা হচ্ছে। তবে বাসা বাড়িতে পানি জমে থাকায় সেগুলোতে লার্ভা জমাচ্ছে। সেসব জায়গা পরিস্কার করতে হবে।
আবুল খায়ের