পৌষের মাঝামাঝি এসে সারাদেশে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। কুয়াশায় ঢাকা থাকছে সকালের সূর্য। ঘন কুয়াশায় বিপর্যস্ত জনজীবন। বিঘ্নিত হচ্ছে বিমান, ট্রেন, লঞ্চ, ফেরি ও গাড়ি চলাচল। এক কথায় পুরো যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত। কনকনে শীতে জবুথবু উত্তরের মানুষ। কাজের সন্ধানে বেরিয়ে তীব্র ঠাণ্ডা আর ঘন কুয়াশার কারণে বিপাকে পড়ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। শীতের তীব্রতা বেড়েছে রাজধানীতেও। ভোগান্তি বেড়েছে বৃদ্ধ ও শিশুদের।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক আমাদের সময়কে বলেন, মঙ্গলবার দেশের অধিকাংশ এলাকা কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে দিনের তাপমাত্র ৭ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলিসিয়াসে নেমেছিল। এমন অবস্থা আরও তিন থেকে চার দিন থাকতে পারে।
ঘন কুয়াশা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেশি কুয়াশ ছিল রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও খুলনায়। সর্বনিম্ন দৃষ্টিসীমা ছিল নেত্রকোনা ও ফরিদপুরে, ১০০ মিটার।
এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে গতকাল সকাল থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণ বন্ধ ছিল। আন্তর্জাতিক দুটি ফ্লাইট ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করতে না পেরে চট্টগ্রামে চলে যায়। বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. কামরুল ইসলাম বলেন, রানওয়ের ভিজিবিলিটি (দৃশ্যমানতা) কম থাকায় ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা ৫মিনিট পর্যন্ত ঢাকা বিমানবন্দরে কোনো ফ্লাইট ওঠানামা করেনি।
ঘন কুয়াশার কারণে প্রায় ছয় ঘণ্টা রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া এবং মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। ঘন কুয়াশার কারণে গতকাল ভোর পৌনে ৪টা থেকে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। সকাল পৌনে ১০টার দিকে কুয়াশা কেটে গেলে চলাচল স্বাভাবিক করা হয়। দীর্ঘ সময় ফেরি বন্ধ থাকায় ঘাটে আটকে পড়ে কয়েকশ যানবাহন। দুর্ভোগে পড়েন যাত্রী ও চালকরা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সালাহ উদ্দিন জানান, দুর্ঘটনা এড়াতে ফেরি চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
শৈত্যপ্রবাহের পাশাপাশি ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন উত্তরাঞ্চল। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত একটানা কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পরেই হাটবাজার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পঞ্চগড়ে দিনের অধিকাংশ সময় সূর্যের দেখা মেলেনি। তেঁতুলিয়ায় গতকাল সকাল ৯টায় ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হলেও সূর্য না ওঠায় শীতের দাপট কমেনি। রাস্তাঘাটে লোকজন ও যানবাহন চলাচল ছিল কম। শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে মানুষ। যানবাহনগুলো চলছে হেডলাইট জ্বালিয়ে।
এ ছাড়া গত কয়েক দিন ধরে উত্তরের জেলাগুলোতে তীব্র শীতের প্রভাব পড়েছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। প্রতিদিনই চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভিড় করছেন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষ। তাদের মধ্যে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগী বেশি।
এদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহের মতো না হলেও ঢাকায় বইছে হিমেল হাওয়া। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাজধানীতে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। দিনের তাপমাত্রা হুট করে ৫ ডিগ্রির মতো কমে যাওয়ায় ঢাকাবাসী টের পাচ্ছে শীতের তীব্রতা।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ঢাকায় হুট করে শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। প্রচুর কুয়াশা এবং সূর্যের দেখা না পাওয়ায় শীতের তীব্রতা বেড়েছে। জানা যায়, সোমবার ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গতকাল ৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি কমে নেমেছে ১৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার পূর্বাভাসে বলা হয়Ñ অস্থায়ীভাবে আকাশ মেঘলা থাকতে পারে। আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। উত্তর বা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে। দিনের তাপমাত্রা আরও কিছুটা কমে আসতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। তাপমাত্রার বিষয়ে বলা হয়, সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। গতকাল সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে শ্রীমঙ্গলে ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, হাড়কাঁপানি শীত পড়েছে রাজশাহীতে। গতকাল সারাদিন সূর্যের দেখা মেলেনি। এর আগে সোমবার সন্ধ্যা থেকেই কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রাজশাহী। রাতে কেবল সড়কের লাইটপোস্টের বাতিগুলো দেখা যায়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো ঝরছে কুয়াশা। রাত ৮টার মধ্যেই রাস্তাঘাট ও হাটবাজার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ঘন কুয়াশা কেটে গেলে শীতের তীব্রতা বাড়বে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
শীত ও ঘনকুয়াশার কারণে ঘরের বাইরে বেরিয়ে বিপাকে পড়ছেন শ্রমজীবী মানুষ। ঘন কুয়াশায় সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। দূরপাল্লার যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। সকালে দৃষ্টিসীমা ১০০ মিটারের নিচে নেমে আসায় যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে।
ঘন কুয়াশার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে গতি কমেছে ট্রেনেরও। ফলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আন্তঃনগরসহ বিভিন্ন রুটের ট্রেনের শিডিউল ভেঙে পড়েছে। বিলম্বে চলার কারণে সময় অপচয় হচ্ছে রেলপথ যাত্রীদের। কদিন ধরে রাজশাহী-ঢাকা ও খুলনা-রাজশাহীসহ বিভিন্ন রুটে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর সূচি এলোমেলো হয়ে গেছে।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আবদুস সালাম বলেন, গতকাল ভোর ৬টায় রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুপুর ২টায় ছিল ১৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রাজশাহীর ওপর দিয়ে কোনো শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে না। মূলত কুয়াশা কেটে গেলেই শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে। তখন রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আবার এক অঙ্কে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকা বিমানবন্দরে নামতে না পেরে চট্টগ্রামে জরুরি অবতরণ করে সিঙ্গাপুর ও শারজাহ থেকে আসা ইউএস-বাংলার দুটি ফ্লাইট। দেড় ঘণ্টা চট্টগ্রামে অবস্থানের পর কুয়াশা কেটে গেলে ফের ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় ফ্লাইট দুটি। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার তাসনিম আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রের্কড করা হয়; ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। কনকনে বাতাস আর ঘনকুয়াশায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।