প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বন্ধন, বৈবাহিক সম্পর্ক, প্রেম ভালোবাসার মতো পবিত্র সম্পর্কগুলো ভাঙছে প্রতিনিয়ত। নিঃসঙ্গদের সময় কাটাতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো দেশেও এখন বেশ কয়েক ধরনের ডেটিং অ্যাপ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, ডিভোর্সি, বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে। এরমধ্যে টিন্ডার, বাম্বল, ওকেকিউপিড, ট্যানট্যান ও মাম্বাসহ বেশকিছু অ্যাপ রয়েছে, যা বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশে প্রায় ২০টির মতো ডেটিং অ্যাপের ব্যবহার রয়েছে। নতুন সম্পর্ক তৈরিতে এসব অ্যাপের সুফলের পাশাপাশি অপব্যবহার নিয়ে বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছে মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করে আর্থিক প্রতারণা, এমনকি অপহরণ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একাধিক চক্র। সোনিয়া। বয়স ১৮ বছর। কলেজের গণ্ডি না পেরোলেও কম বয়সে গড়ে তুলেছে ডেটিং অ্যাপের ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ভাড়া বাসায় থাকে এই প্রতারক পরিবার। গত বছরের শুরুর দিকে এক ব্যবসায়ী যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় সোনিয়ার। এরপর রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে সোনিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন ভুক্তভোগী যুবক। আগে থেকেই ঘটনাস্থলে ওত পেতে থাকেন প্রতারক চক্রের সদস্য সোনিয়ার বাবা মো. জলিল এবং তার সহযোগী ইউসুফ।
ভুক্তভোগী যুবক ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তাকে একটি গাড়িতে অপহরণ করে যাত্রাবাড়ীর একটি ফ্ল্যাটে আটকে রাখা হয়। এরপর যুবকের আপত্তিকর ছবি তুলে রেখে দেন। সোনিয়া জানায়, প্রথমে অ্যাপের মাধ্যমে পুরুষদের লক্ষ্যবস্তু করতেন। এরপর ক্রমশ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে ফ্ল্যাট বাড়ি কিংবা সুনির্দিষ্ট একটি জায়গায় দেখা করার আমন্ত্রণ জানিয়ে আটকে আপত্তিকর ছবি তুলে দীর্ঘদিন ধরে এভাবে প্রতারণা করে আসছিলেন। প্রতারণার শিকার যুবক পরবর্তীতে গত ২৮শে ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করলে সাইবার ক্রাইম বিভাগ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সোনিয়া মূলত একটি অপহরণ চক্রের সদস্য ও কলগার্ল। ভুক্তভোগী যুবক দেখা করতে যাওয়ার পরে সুকৌশলে সোনিয়া ও তার চক্রের সদস্যরা যুবককে তাদের গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে একটি অচেনা এলাকার ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। চোখ খোলার পর ওই যুবক দেখতে পায়, সেখানে শুধু সোনিয়াই নয় সেই অপহরণ চক্রের আরও কয়েকজন নারী ও ৫-৬ জন বিভিন্ন বয়সী পুরুষ উপস্থিত। যুবক কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ওপর শারীরিক নির্যাতন করতে শুরু করে। চরম নির্যাতনের একপর্যায়ে তার সঙ্গে আপত্তিকরভাবে চক্রের নারীদের কিছু ছবি ও ভিডিও করা হয়। ছবি তোলা ও ভিডিও করা শেষে চক্রের সদস্যরা রাকিবের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে।
কিন্তু টাকা দিতে অপারগতা জানান ভুক্তভোগী। এতে করে চক্রের সদস্যরা তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় অপহরণকারীরা। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে ২ লাখ টাকা এনে অপহরণকারীদের দেন। কিন্তু তাতেও মন গলেনি তাদের। তারা আরও টাকা দাবি করে। একপর্যায়ে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও তাদের হেফাজতে রেখে তাকে মুক্তি দেয় প্রতারকরা। তানিয়া সুলতানা। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম। বাবা একটি বেসরকারি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। হঠাৎ করে তানিয়ার মুঠোফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসতে শুরু করে। এবং প্রত্যেকেই তাকে প্রেমের প্রস্তাবের পাশাপাশি নানান ধরনের কুপ্রস্তাব দিতে থাকে। বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করলে তারা আকাশ থেকে পড়েন। এভাবে টানা কয়েকদিন চলতে থাকে। পরবর্তীতে তানিয়া সিদ্ধান্ত নেন তার ব্যবহৃত সিমটি বন্ধ রাখবেন। এরপর তার পরিবারের সিদ্ধান্তে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাবা স্থানীয় থানা এবং সাইবার ক্রাইমে একটি সাধারণ ডায়েরি করলে প্রতারককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
হাতে লেখা চিঠি বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাইরে বহুদিন ধরেই নতুন সম্পর্ক তৈরির জন্য বিশ্বের বহু দেশে ডেটিং অ্যাপগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেই ঢেউয়ে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরাও। এখন অনেকেই এসব ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে সঙ্গী খুঁজতে শুরু করেছেন। এসব ডেটিং অ্যাপে সবসময়ই যে প্রতারণার ঘটনা ঘটে তেমনটি নয়। অনেক সময় অ্যাপের মাধ্যমে পরিচয় শেষে পরিণয় বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। তেমনই এক দম্পতি (ছদ্মনাম) কাজল রেখা এবং সাব্বির হোসেন। ঢাকার বাসিন্দা সাব্বির টিন্ডার নামের একটি ডেটিং অ্যাপে নিবন্ধন করেছেন। ২০১১ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় সাব্বিরের। কিন্তু স্ত্রীর অন্যত্র প্রেম থাকায় এক বছরের মধ্যে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। কাজল রেখারও এর আগে বিয়ে এবং একটি সন্তান রয়েছে। কাজল জানায় ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পরিবারকে পাশে না পেয়ে জীবনটা বিষিয়ে উঠেছিল। এক সময় বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলি। বড্ড একা লাগছিল। প্রথমে একটি ডেটিং অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম। এরপর সেটায় খুব ভালো সাড়া না পাওয়ায় একে একে তিনটি ডেটিং অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করি। তৃতীয় অ্যাপেই সাব্বিরের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর আমরা উভয়ই দেখা করি। এবং নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে শেয়ার করি। পরবর্তীতে বিষয়টি পরিবার পর্যন্ত গড়ায়।
কিছুদিন পরেই আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেই। এখন আমরা ভালো আছি। নাম না প্রকাশের শর্তের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, বাবা-মা পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে কখনো দূরে থাকিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ঢাকায় এসে একা থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। পরবর্তীতে এক বন্ধুর পরামর্শে ডেটিং অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করি। প্রথম দিকে অনেকের সঙ্গেই সারা রাত জেগে কথা হতো। কিন্তু একপর্যায়ে এসে বুঝতে পারি আমি ভুল পথে হাঁটছি। এ ছাড়া ডেটিং অ্যাপে কথা বলে ভালোলাগা কাজ করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা করার পর আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। টিন্ডার, বাম্বলের মতো কোনো কোনো অ্যাপে মেয়েদের জন্য বিশেষ সুবিধা রয়েছে। এখানে কাউকে পছন্দ হলে মেয়েদের আগে বার্তা পাঠাতে হয়। পরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই বার্তার জবাব পাওয়া গেলে সংযোগ তৈরি হয়, না হলে সেটি মুছে যায়। সাধারণত ডেটিং অ্যাপে বার্তা বিনিময়ের মাধ্যমে পরিচয়, আলাপচারিতার পর ফোন নম্বর বিনিময় বা দেখা-সাক্ষাতের প্রসঙ্গ আসতে পারে। বন্ধুত্ব বা প্রেম- নানা ধরনের সম্পর্ক তৈরির জন্য প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে বর্তমান প্রজন্ম। চাকরি-বাকরি নিয়ে ব্যস্ততার কারণে সামাজিক মেলামেশা বেশি একটা হয় না।
তাই বন্ধু খোঁজার জন্যই এসব অ্যাপ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন অনেকেই। ছেলেদের তুলনায় ডেটিং অ্যাপগুলোয় অংশ নেয়া মেয়েদের সংখ্যা কম বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, শুধু ২/১ জনের ক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে তা নয়। ডেটিং অ্যাপ টিন্ডার, টানটান, মাম্বা ব্যবহার করে অনেক নারী পুরুষই এখন প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন। এসব অ্যাপ ঘিরে ফাঁদ পেতে রেখেছে অপহরণকারী ও প্রতারক চক্র। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী নেহাল করিম বলেন, আমাদের আর্তসামাজিক ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে আমরা স্বাভাবিকভাবে সুস্থ চিন্তা করতে পারি না। এজন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সকলেই দায়ী। আমাদের সময় এ ধরনের অ্যাপের প্রচলন ছিল না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তখন ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না। এ বিষয়ে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, প্রায়ই এ ধরনের ডেটিং অ্যাপ প্রতারণার অভিযোগ আসে। গত বছর এ ধরনের অসংখ্য প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রায় ২০টির মতো ডেটিং অ্যাপ রয়েছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে পারে। এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে আমাদের সাইবার ক্রাইম বিভাগ তৎপর রয়েছে।