সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাও বাড়ানো হতে পারে বলে জানা গেছে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া সরকারি চাকরি থেকে অবসরের সময়সীমাও বাড়ানো হচ্ছে। অবসরের বয়স কমপক্ষে ৩ বছর বাড়িয়ে ৬২ বছর করা হতে পারে। বর্তমানে অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছর। আর মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীদের অবসরের সীমা হচ্ছে ৬০ বছর।
বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করে নোট দেয়ায় নতুন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসেছে। এছাড়া সরকার ষাটোর্ধ্ব বয়সিদের সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করলেও নতুন করে সিনিয়র সিটিজেনের বয়সসীমা ৬৫ করার পক্ষে মত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া নোটে উল্লেখ করেন, আমাদের দেশে সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৫৯ বছর। এ বিষয়টি আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ছিল ৫৮ বছর। ব্রিটিশ আমলে ছিল ৫৫ বছর। ’৭২ সালে আমাদের দেশে মানুষের জীবনসীমা ছিল মাত্র ৫৮ বছর। এসব কিছু বিবেচনা করলে আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা আরও তিন বছর বাড়িয়ে ৬২ বছর করা যায়। অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, আমাদের জীবনসীমা বর্তমানে ৭০ বছরের বেশি। এ অবস্থায় আমাদের সিনিয়র সিটিজেনের বয়সসীমা ৬৫ বছর নির্ধারণ করা যথাযথ হবে বলে আমি মনে করি। অর্থমন্ত্রীর ওই নোটে আরও উল্লেখ করেন, আমরা ৬০ বছরের বেশি বয়সি নাগরিকদের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি। এসব সিটিজেনের জন্য আমরা এখনও তেমন বিশেষ সুবিধা দিতে পারছি না। তবে তাদের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ সুবিধা প্রদানের সরকারি চিন্তাভাবনা রয়েছে। মূলত অর্থমন্ত্রী এ নোট প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের পরই সরকারি চাকরি থেকে অবসরের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত কয়েক বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীরা অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর করার দাবিতে সভা-সমাবেশ করে আসছেন। এমনকি তারা বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে একাধিক মামলা করেছেন। আদালতের নির্দেশনা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের অবসরের সময়সীমা ৬২ করার প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হলে তা সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল হয়েছে। তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠন সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে সরব রয়েছে। অবশেষে অর্থমন্ত্রী অবসরের সময়সীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাব করেছেন। অপরদিকে বেকার যুবকরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। তাদের যুক্তি, সেশনজটের কারণে তাদের শিক্ষাজীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান কয়েকটি বছর হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের চাকরি উপযোগী শিক্ষা অর্জনের পর আর মাত্র ২-৩ বছর সময় হাতে থাকছে। এ সময়ের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে চাকরি পাওয়া অসম্ভব। সেক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি তাদের। এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছরের ওপর। অথচ আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সীমা হচ্ছে ৩০ এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ৩২ বছর। সরকার বিষয়টি বিবেচনা করছে বলে জানা গেছে। এদিকে সিনিয়র সিটিজেনদের পড়ন্ত জীবনে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব সুবিধা দেয়ার কথা, তার একটি নিয়েও কাজ শুরু করেনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এমনকি প্রবীণদের জন্য পরিচয়পত্র তৈরি করতে পারেনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া সরকারিভাবে জেলা পর্যায়ে এক বা একাধিক প্রবীণনিবাস তথা আবাসন নির্মাণের কথা থাকলেও তা শুরু হয়নি বলে জানা গেছে। প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করে প্রবীণদের রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের উদ্যোগ নেয়া, মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালগুলোয় জেরিয়াট্রিক মেডিসিন (জ্বরাবিজ্ঞান) কর্নার খোলার ব্যবস্থা নেয়ার কথা থাকলেও তা চালু করা সম্ভব হয়নি।
তাদের জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে আইডি কার্ডের আদলে বিশেষ কার্ড তৈরি করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাতে রাজি হয়নি। সিনিয়র সিটিজেনরা বিশেষ মর্যাদা ভোগ করবেন। বিশেষ করে চিকিৎসাসেবায় তাদের বাড়তি সুবিধা পাওয়ার কথা, যাতায়াতের সময় গণপরিবহণে অর্ধেক ভাড়া ও সিট সুবিধা পাওয়ার কথা, ভবিষ্যতে সরকারি-বেসরকারি আবাসিক ভবনে তাদের বসবাসের জন্য বিশেষ সুবিধা অর্থাৎ গোসল ও বাথরুম সুবিধা রাখার কথা, শিক্ষিত, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ সিনিয়র সিটিজেনদের কাছ থেকে শিক্ষার মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মকৌশল প্রণয়ন সরকারিভাবে নেয়ার কথা। এর কোনোটিই পুরোপুরি শুরু হয়নি বলে জানা গেছে। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সাবেক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়ার নিয়ম চালু করেছে।
প্রণীতব্য প্রবীণ উন্নয়ন আইনে জেলায় জেলায় প্রবীণবান্ধব ব্যায়ামাগার ও প্রবীণদের জীবনমান উন্নয়নের ব্যবস্থা নেয়ার কথা ছিল। শিক্ষা পাঠ্যক্রমে সঠিক খাদ্যাভ্যাসের পাঠ্যক্রম ও ব্যায়ামচর্চা চালুর কথা ছিল। দুর্যোগকালীন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবীণদের সহায়তা করার কথা ছিল। পর্যায়ক্রমে প্রবীণদের জন্য ইউনিভার্সেল নন-কন্ট্রিবিউটরি পেনশন স্কিম চালু করার কথা ছিল। প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নিজস্ব তহবিল গঠনের কথা ছিল। কিন্তু এর কোনোটিই শুরু করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ষাটোর্ধ্ব নারী-পুরুষ রয়েছেন। তাদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার মধ্যে জীবনযাপন করছেন। তাদের মধ্যে সরকারিভাবে ২৭ লাখ ২৩ হাজার জনকে মাসিক ৩০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা দেয়া হচ্ছে। ভাতার টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। বিপুলসংখ্যক প্রবীণ ব্যক্তি সরকারি সীমাবদ্ধতার কারণে ভাতা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারি হিসাবে, বর্তমানে দেশে মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছর ৬ মাস। অর্থাৎ ষাট বছর বয়স হলেই কেউ আর কোনো বিষয়ে কাজ করতে পারবেন না এমন নয়। যিনি যে পেশায় কাজ করেছেন, তাকে সে কাজের পরামর্শক হিসেবে সম্মানীসহ নিয়োগ দেয়ার কথা। প্রবীণদের জন্য লঞ্চ, নৌকা, বাস, ট্রেন ও বিমানে রিজার্ভ সিট রাখার কথা। অর্ধেক ভাড়া অর্থাৎ ১০০ টাকা ভাড়া হলে তাদের ৫০ টাকায় ভ্রমণ করার কথা। অনেক প্রবীণ অর্থকষ্টের কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন না। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিস ও কিডনি ডিজিসের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। তাদের এসব রোগের চিকিৎসা দেয়ার কথা। তাদের জন্য হাসপাতালে চিকিৎসা কর্নার খোলার কথা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেজিয়েট্রিক মেডিসিন বিভাগ রয়েছে। প্রবীণ নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য আলাদা সিট বরাদ্দ রাখার কথা। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রবীণদের চিকিৎসা দিতে বাধ্য থাকবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানকে বাসাবাড়ি নির্মাণের সময় প্রতিটি বাসায় একটি করে প্রবীণ কক্ষ নির্মাণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করার কথা। ওই কক্ষটি কেবল পরিবারের প্রবীণ সদস্যই ব্যবহার করবেন। সহজে টয়লেটে যাতায়াতের সুবিধা, লেখাপড়া, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের সুযোগ থাকবে বিশেষ ওই কক্ষটিতে। প্রবীণদের মধ্যে একেবারেই অসহায় এমন ব্যক্তিদের সরকারি শিশু পরিবারে আবাসন ব্যবস্থা করার কথা। তাদের শিশু পরিবারের ওল্ড হোমে বসবাসের ব্যবস্থা করার কথা। বর্তমানে দেশের ৫০টি জেলায় বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। সরকার ৬৪ জেলায় বৃদ্ধাশ্রম স্থাপন করবে বলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে সিনিয়র সিটিজেনরা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন না, তা অকপটে স্বীকার করলেন অর্থমন্ত্রী নিজেই।