সরদার আবুল বাসার ॥
আগামীকাল ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫, রঘুনাথপুর বাজার গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সানের এ দিনে কচুয়া উপজেলার রঘুনাথপুর বাজারে পাক-হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে প্রায় অর্ধশত লোক শহীদ হন। এই শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ১৯৯৬ সনে গঠিত হয় রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদ। এই স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে প্রতি বছর রঘুনাথপুর এলাকাবাসীদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে ৮ সেপ্টেম্বরকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছি। এবারও দিবসটি পালনের জন্য গত ৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে স্মৃতি সংসদের সভাপতি সর্দার আবুল বাসার এর সভাপতিত্বে রঘুনাথপুর বাজারে এক প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ৮ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩ টায় রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে আলোচন সভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে সম্মত হয়েছেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চাঁদপুর জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাল যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধ এম.এ. ওয়াদুদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য সম্মত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধ কালীন এফ.এফ. কমান্ডার হাজীগঞ্জ উপজেলা কমান্ডের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধ মোঃ মজিবুর রহমান মজুমদার, কচুয়া উপজেলার কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মবিন, মুক্তিফৌজ ফাউন্ডেশন চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি পৌকশলী দেলোয়ার হোসেন।
অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সকলকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি সর্দার আবুল বাসার।
রঘুনাথপুর বাজারের অবস্থান ও প্রেক্ষাপট ঃ
মতলব, হাজীগঞ্জ ও কচুয়া এ তিন থানার সীমানায় অবস্থিত অবহেলিত জনপদ রঘুনাথপুর বাজার। মতলব সদর থেকে ১২ কি.মি পূর্বে, হাজীগঞ্জ সদর থেকে ১০ কি.মি উত্তরে এবং কচুয়া থানা সদর থেকে ৫ কি.মি পশ্চিমে জেলার প্রত্যন্ত নিরিবিল স্থানে এ বাজারটির অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বর্ষা মৌসুমে এ বাজারে নৌ-পথে আসা ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। হাজীগঞ্জ, কচুয়া ও মতলব থানার লোকজন ছাড়াও বরুড়া, চান্দিনা, দাউদকান্দি, গজারিয়া থানা এলাকায় লোকজনও এ বাজারটিকে মুক্তিযুদ্ধকালনি নিরাপত্তার বেচাকেনার স্থান এবং মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নিয়েছিলো। সপ্তাহে কেবলমাত্র বুধবার এ বাজারটি বসে। মুক্তিযুদ্ধকালে এ বাজারে প্রতি বুধবার অনেক লোকের সমাগম হতো।
মন্তা নামের এক লোক এ বাজারে পাট ব্যবসা করতো। সে রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধকালনি জমজমাট এ বাজারটিতে পাট ব্যবসার নামে কখনো ছদ্মবেশে এসে এই মন্তা তার সহযোগিদেরে দ্বারা বাজারের আশেপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান এবং বিভিন্ন বষিয়ে অবহিত হয়ে হাজীগঞ্জ ক্যাম্পে নিয়ে পাক-বাহিনীর সাথে আলাপ করে রাজাকার বাহিনী দ্বারা বাজারটিতে পরিকল্পিত হামলার ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়।
১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বুধবার। সেদিন ছিলো রঘুনাথপুর বাজারের সাপ্তাহিক হাটবার। প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছিল বাজারে। ভরা বর্ষায় চতুর্দিক থেকে নৌকাযোগে ক্রেতা-বিক্রেতায় বাজারটি ছিল পরিপূর্ণ। আনুমানিক বিকেল ৩টায় ৫০/৬০ জন রাজাকার ছইওয়ালা ৬/৭টি নৌকায় করে বাজারের পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক দিয়ে বাজারে প্রবেশ করে। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আঃ মতিন তখন ছিলেন বাজারের দীঘির পূর্ব-উত্তর কোণে বগীরমার বাড়ি বলে পরিচিত বাড়িটির পাশের কেটি নৌকাতে। তিনি রাজাকারদের আগমন টের পান এবং এল.এম.জি তাক করেন আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার সহযোগিরা বাজারের হাজার হাজার লোকের জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতির আশংকায় এ আক্রমণে তাকে বারণ করেন। এ সময় রাজাকারদের পূর্ব নিয়োজিত ইনফরমারদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে প্রথমেই মুক্তিযোদধা আঃ মতিনকে গুলি করে হত্যা করে তাদের অপারেশনের প্রথম বাধা দূর করা হয়। তারপর রাজাকাররা ফাঁকা গুলি চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বাজারের অপ্রস্তুত লোকজন গুলির আওয়াজে জ্ঞানশূন্য হয়ে বিভিন্ন দিকে পালাতে শুরু করে। বাজারের মধ্যবর্তী বোয়ালঝুরি খালের ওপরে বর্তমান নতুন ব্রীজটির প্রায় ২০০ গজ দক্ষিণে ছিলো কাঠের পুল। কাঠের পুলের পশ্চিম পাড়ে পাটের ব্যবসায়ী রাজাকার মন্তা রাইফেল হাতে সহযোগি রাজাকারদের গাইড লাইন দিচ্ছে দেখে পাট মাপার কাজে নিয়োজিত তারাপল্যা গ্রামের সাহসী যুবক সামছুল হক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সে দৌড়িয়ে গিয়ে রাজাকার মন্তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ‘মন্তা তুই! এ বাজারের লোক হয়ে তুই কিভাবে এ বাজার আক্রমণ করতে আস্ছিস? এ নিয়ে রাজাকার মন্তার সাথে সামছুল হকের বাক-বিতন্ডা শুরু হয়ে যায। এক পর্যায়ে সামছুল হক মন্তাকে ঝাঁপটে ধরে হাতাহাতি শুরু করে, রাইফেলটি ছিনিয়ে নিয়ে মন্তাকে ফেলে দিয়ে রাইফেল দিয়ে পিটাতে শুরু করে। এ সময় সামছুল হককে সাহায্য করতে দ্রুত ঘটনাস্থলে এগিয়ে আসে তার পিতা ওয়াজউদ্দিন ও প্রতিবেশি জুনাব আলী। এমনটি দেখে অন্যান্য রাজাকাররা প্রথমে সামছুল হককে এবং পরপর ওয়াজউদ্দিন ও জুনাব আলীকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় তাদের গুলিতে নিহত হয় ৭ম শ্রেণির ছাত্র আঃ রশিদ খন্দকার, যার লাশ কবুতরের খাঁচা জড়িয়ে পড়তে থাকতে দেখা যায। তারপর রাজাকাররা চালায় নির্বিচার গুলি ও লুটতরাজ। বাজারে মসজিদের দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তান থেকে সদ্য এম.এ পাস করে আসা মদ্দিরবাগ গ্রামের নজরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার কয়েক গজ দূরে তখনকার কলেজ ছাত্র, কাদলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এ.কে.এম মাঈনউদ্দিন মজুমদারকে গুলি করার উদ্দেশ্যে অন্যান্যদের সাথে লাইনে দাঁড় করানো হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। রাজাকাররা রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়কে অস্ত্র নির্মাণাগার এবং অস্ত্রের ভান্ডার মনে করে বিদ্যালয়ের ব্যঅপক ক্ষতিসাধন করে ও বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। এমনি করে রাজাকাররা কয়েক ঘন্টা তান্ডবলীলা (হত্যাযজ্ঞ) ও ব্যাপক লুটতরাজ শেষ করে মুক্তিযোদ্ধা আঃ মতিনের লাশ হাজীগঞ্জে নিয়ে যায় এবং তার লাশ হাজীগঞ্জ বাজারে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে টেনে হেঁচড়ে উল্লাস করে টাঙ্গিয়ে রেখে প্রদর্শন করে।
স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধের এই মর্মান্তিক ঘটনা পঁচিশ বছরেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। যারা নিহত হয়েছেন, তাঁরা পাননি শহীদের মর্যাদা এবং তাঁদের পরিবারও পায়নি ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা। এ ব্যাপারে সরজমিনে প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য ডিসেম্বর ’৯৬ চাঁদপুরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা চলাকালীন সময়ে বিজয় মেলার দপ্তরে বসে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়- এ বিজয় মেলার দপ্তর উপ-পরিষদের আহ্বায়ক সরদার আবুল বাসারের পৃষ্ঠপোষকতায় তত্ত্ব ও তথ্য সংরক্ষণ ও গবেষণা উপ-পরিষদ ও জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব বাসুদেব মজুমদার এবং চাঁদপুরস্থ হাজীগঞ্জ সমিতির ঐকান্তিক আগ্রহে তৎকালীন সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠের ভারপাপ্ত সম্পাদক কাজী শাহাদাত, আজকের কাগজের জেলা প্রতিনিধি জনাব হাবিবুর রহমান খান, ভোরের কাগজের জেলা প্রতিনিধি জনাব আলম পলাশসহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ১৫ ডিসেম্বর ’৯৬, ৬ জানুয়ারি ’৯৭ ও ২২ জানুয়ারি ’৯৭ তিন দফা রঘুনাথপুর বাজার এলাকায় আসেন। তাঁরা বিভিন্ন স্থানের কয়েক শতাধিক ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করে ক্যাসেটে তা’ ধারণ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্র সংগ্রহ করে ধারাবাহিকভাবে ‘চাঁদপুর কণ্ঠে’ প্রকাশ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাজাকাররা চলে যাবার পরপরই স্থানীয় লোকজন একত্রিত হয়ে রঘুনাথপুর বাজারে পড়ে থাকা সতেরটি লাশ দেখতে পান। তন্মধ্যে ৫টি বাজারের মধ্যবর্তী খালের পশ্চিম পাড়ে এবং বারটি পূর্ব পাড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, এ সতেরটি ছাড়াও অনেক লাশ তাদের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, প্রায় অর্ধশতাধিক লোক এ হত্যাকান্ডে শহীদ হন। আমরা এ পর্যন্ত যে শহীদদের তালিকা পেয়েছি তা’ হচ্ছে ঃ ১) শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আঃ মতিন, গ্রাম- রাজাপুর, থানা- শাহরাস্তি, ২) শহীদ সামছুল হক, পিতা- শহীদ ওয়াজ উদ্দিন, ৩) শহীদ ওয়াজউদিদœ, গ্রাম- তারাপল্যা, থানা- হাজীগঞ্জ, ৪) শহীদ জুনাব আলী, গ্রাম- তারাপল্যা, থানা- হাজীগঞ্জ, ৫) শহীদ আব্দুল আউয়াল চৌদুরী, পিতা- বাদশা মিয়া, গ্রাম- ধড্ডা, থানা- হাজীগঞ্জ (বর্তমান চাঁদপুর জেলা বার সভাপতি অ্যাড, আহসান হাবীবের পিতা), ৬) শহীদ মোয়াজ্জেম আলী, গ্রাম- মহব্বতপুর, থানা- হাজীগঞ্জ, ৭) শহীদ নজরুল ইসলাম, পিতা- ছেরাজল হক ভূঁইয়া, গ্রাম- মদ্দিরবাগ, থানা- কচুয়া, ৮) শহীদ প্রাবল্লভ শীল, গ্রাম- রামপুর, থানা- হাজীগঞ্জ, ৯) শহীদ গিরিশ চন্দ্র সরকার, পিতা- ঈশ্বর চন্দ্র সরকার, গ্রাম- পরানপুর, থানা- কচুয়া, ১০) শহীদ মোখলেছুর রহমান, পিতা- মোঃ মনু মিয়া, গ্রাম- ওড়পুর, থানা- হাজীগঞ্জ, ১১) শহীদ জংশর আলী, পিতা- আজিমউদ্দিন, গ্রাম- ওড়পুর, হাজীগঞ্জ, ১২) শহীদ আবদুর রব, পিতা- মৃত ইছহাক মুন্সী, গ্রাম- ওড়পুর, থানা- হাজীগঞ্জ, ১৩) শহীদ আঃ রশিদ খন্দকার, (সপ্তম শ্রেণির ছাত্র), পিতা- আলী আকবর, গ্রাম- সাঁড়াশিয়া, থানা- হাজীগঞ্জ, ১৪) শহীদ জাহানারা, (বয়স- ৮ বছর), পিতা- মৃত আঃ মালেক, গ্রাম- দেবিপুর, থানা- কচুয়া।
মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর চলে গেছে, রঘুনাথপুর বাজারের শহীদদের স্মৃতি হারিয়ে যেতে দেখে আমরা কয়েকজন বিগত ৬ জানুয়ারি ’৯৬ তারিখে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে এক সভায় মিঞা মোঃ ওয়াহিদুল আলমকে সভাপতি এবং সরদার আবুল বাসারকে সাধারণ সম্পাদক করে রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদ গঠন করি। এ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে এবং চাঁদপুরস্থ হাজীগঞ্জ সমিতির সহযোগিতায় গত ১৩ জানুয়ারি ’৯৭ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এম.এ ওয়াদুদের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে রঘুনাথপুর বাজারের যুদ্ধকালীন উপরোক্ত ঘটনাবলী অবহিত করি। তিনি অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে ঘটনাবলী শুনেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ’৯৭ রঘুনাথপুর বাজারে শহীদদের স্মৃরণে নির্মিতব্য স্মৃতি স্তম্ভের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সম্মতি দেন। অবশেষে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে মাঠে ১৬ ফেব্রুয়ারি ’৯৭ অপরাহ্ন দেড়টায় আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। এতদ উপলক্ষে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ খালিদ আনোয়ার প্রধান অতিথি, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার জনাব এম.এ ওয়াদুদ, হাজীগঞ্জ থানা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব খন্দকার আতিয়ার রহমান ও কচুয়া থানা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব অনন্ত কুমার চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অন্যান্যদের মধ্যে চাঁদপুরস্থ হাজীগঞ্জ সমিতির সভাপতি অধ্যাপক কবি জাকির হোসেন মজুমদার, চাঁদপুর সদর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হারুন অর রশিদ চৌধরী, জেলা ডেপুটি কমান্ডার মাস্টার ওয়ারেন্ট (অবঃ) আঃ হাফিজ খান, কচুয়া থানা কমান্ডার এম.এ মবিন, গুলবাহার কলেজের অধ্যক্ষ, ধড্ডা মোয়অজেন হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ, চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যাপক মাসুদুর রহমান, আজকের কাগজের জেলা প্রতিনিথি হাবিবুর রহমান খান, দৈনিক মিল্লাতের জেলা প্রতিনিথি মনজুর আলম মনা, নিউজ মিডিয়া সংবাদদাতা মোঃ নেয়ামত হোসেন, দৈনিক ভোরের কাগজের জেলা প্রতিনিধি আলম পলাশ, সাপ্তাহিক চাঁদপুর সংবাদের সহকারী সম্পাদক এম.এ রাজ্জাক, দৈনিক দিনকালের নিজস্ব সংবাদদাতা শাহ মোঃ সেলিম, চাঁদপুর জেলা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব বাসুদেব মজুমদার, কবি ও লেখক সংগঠন কাব্যলোকের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অত্র এলাকার কৃতি সন্তান জনাব মজিবুর রহমান মজুমদার ছিলেন তৎকালীন বৃহত্তর হাজীগঞ্জের থানা কমান্ডার, যার নাম কুমিল্লা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। তাঁর অনুপ্রেরণায় অত্র এলাকার শত শত লোক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছাড়া অত্র এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সর্বজনাব শামছুল আলম (নাসিরকোর্ট), শরীফ উল্যা পাটওয়ারী (পিরোজপুর), এরশাদ হোসেন মাস্টার (তারাপল্যা), খলিলুর রহমান (মহব্বতপুর), আঃ মান্নান মাস্টার (নিশ্চিন্তপুর), ডাঃ আবদুল ওয়াদুদ মজুমদার (বানিয়াচোঁ), আব্দুল মতিন ভূঁইয়া (মাড়কী), আব্দুল বারী (রাজাপুর), দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়া (মদ্দেরবাগ), আমির হোসেন পাঠান (আয়মা), আবদুল বাসার খান, মিঞা মোঃ ওয়াহিদুল আলম, আবু তাহের রেনু (কাদলা), আবদুল হাই তালুকদার, দেলোয়ার হোসেন (এম.এফ), হাবিবুর রহমান তালুকদার (তারপল্যা), সৈয়দ আহমদ মজুমদার (পিরোজপুর) সহ অনেকে।
রঘুনাথপুর বাজারের হত্যাকান্ড ছিলো লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক এবং মর্মস্পর্শী। গোটা চাঁদপুর জেলার মধ্যে এ হত্যাকান্ড ছিলো সবচেয়ে বড় হত্যাকান্ড। চাঁদপুর জেলার এ পল্লিতে এমন একটি হত্যাকান্ড ঘটলেও ১৯৯৭ সনের পূর্বে তাদের স্মরণ করেনি। তৎকালীন প্রশাসক মোঃ খালিদ আনোয়ার ১৯৯৭ সনের ১৬ ফেব্রুয়ারি রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ভাস্কর্য নির্মাণ করে যেতে না পারলেও একটি শহীদ মিনার নির্মাণের বরাদ্দ দিয়ে গেছেন। যা বর্তমানে স্কুল মাঠে শহীদ মিনারটি শোভা পাচ্ছে। এখন শহীদ মিনারটি সংস্কার প্রয়োজন।
ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের ৪ বছরের পর আবার উদ্যোগ গ্রহণ করি ভাস্কর্য নির্মাণের। ২০০১ সনের ১৬ মার্চ দেশবরেণ্য ভাস্কর্য শিল্পী স্বপন আচার্যী, বিশিষ্ট প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত ভাস্কর্য নির্মিতব্য স্থান রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ পরিদর্শন করেন। সফরসঙ্গী ছিলেন চাঁদপুর রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও দৈনিক চাঁদপুর দর্পণের সহকারী বার্তা সম্পাদক শেখ মহিউদ্দিন রাসেল, সাংবাদিক শাহ মোঃ সেলিম, মুনওয়ার কানন সহ শহীদ পরিবারের সদস্য, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও শান্তিপ্রিয় এলাকাবাসী। প্রায় ৬ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হবে এমন একটি ভাস্কর্য নির্মাণের ডিজাইন তৈরি করেছিলেন দেশবরেণ্য ভাস্কর্য শিল্পী স্বপন আচার্যী। রাষ্ট্রীয় পট পরিবর্তনের কারণে ভাস্কর্যের নির্মাণ কাজ অগ্রসর হয়নি।
রঘুনাথপুর বাজারের শহীদদের স্মরণে একটি কিছু করার কাজ বন্ধ হয়ে যায়নি। সরকার থেকে হাফ শতাংশ ভূমি রঘুনাথপুর বাজারে লিজ নিয়েছেন সরদার আবুল বাসার। এ স্থানে নির্মিত হয়েছে রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদ কার্যালয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্ততঃ বসার স্থান হয়েছে। জেলা পরিষদ থেকে পাওয়া গিয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা। নির্মাণ করা হয়েছে চেয়ার-টেবিল। বর্তমানে অফিস ঘরটির অবস্থা খুবই নাজুক, বৃষ্টি আসলেই পানি পড়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক এবং মর্মস্পর্শী হত্যাকান্ডের শহীদদের স্মরণে নির্মিত অফিস ঘরটি টিনশেড বিল্ডিং নির্মাণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকাবাসীর দাবি।
শহীদ সামছুল হক, শহীদ ওয়াজউদ্দিন ও শহীদ জুনাব আলীর কবর রঘুনাথপুর-চৌমুহনী রোডের পাশে বোয়ালজুড়ি খালের পশ্চিম পাড়ে অযতœ, অবহেলায় পড়ে আছে। রঘুণাতপুরের গণহত্যায় নিহত শহীদদের স্মরণে আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ সুধীজন এগিয়ে আসবেন।
রঘুনাথপুর বলতে কোনো গ্রাম নেই। কচুয়া থানার কাদলা গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রঘুনাথপুর বাজার। আর এই বাজারের পশ্চিম পার্শ্বে রয়েছে বোয়ালজুড়ি খাল ও হাজীগঞ্জ থানার তারাপল্যা গ্রাম। রঘুনাথপুরে কোনো নির্বাচনী কেন্দ্র নেই বলে অনেকেই একে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এলাকার একমাত্র ঐতিহ্যবাহী রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি কচুয়া ও হাজীগঞ্জ থানার সীমানায় অবস্থিত বলে উভয় থানার লোকজনের নেতৃত্বেই বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। ফলে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অত্যধিক। ১৯৯৭ সনের পর বর্তমানে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হলেও শিক্ষক স্বল্পতার কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ায় বিঘœ ঘটেছে। রঘুনাথপুর বাজারটির উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও ডাকঘরটি ৬ শতাংশ ভূমির ওপর অযতœ-অবহেলায় দাঁড়িয়ে আছে। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ডাকঘরটিকে সাব-পোস্ট অফিসে রূপান্তর করার। একমাত্র মসজিদটিও সংস্কার করা প্রয়োজন। রঘুনাথপুর-নাসিরকোট রাস্তাটি পাকাকরণ দীর্ঘদিনের দাবি, যা এখানো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। রঘুনাথপুর-হাজীগঞ্জ, রঘুনাথুর-চৌমুহনী, রঘুনাথপুর-কচুয়া সড়ক পাকা হলেও সংস্কার প্রয়োজন। ঐতিহ্যবাহী রঘুনাথপুর বাজারের ঐতিহ্য আবার ফিিেরয়ে আনা প্রয়োজন বলে মনে করছে এলাকাবাসী। তজ্জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি ও আশির্বাদ।
লেখক পরিচিতি ঃ
সভাপতি, রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদ এবং
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি