চাঁদপুরে সংখ্যালঘুদের ভূমি বাসস্থান প্রভাবশালীরা দখল করে নিচ্ছে ॥
জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন ভূমিকা গ্রহণ করলেও তা কার্যকর হচ্ছে না
শওকত আলী ঃ
চাঁদপুরে সিকি কোটি মানুষের বসবাস হলেও এর মধ্যে মুসলিম ছাড়াও হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের বর্তমানে বসবাস রয়েছে। একসময় স্বাধীনতার পূর্বে হিন্দু সম্প্রদায়ের এখানে ব্যাপক বসবাস হওয়ার ফলে তখন মুসলিম সম্প্রাদায়ের মানুষেরা ছিলো সংখ্যালঘু। এখানে জেলার বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের জমিদারি তথা ভূমি ছিলো তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। কালের পরিবর্তনের ফলে এখন হিন্দু জমিদারতো নেই বললেই চলে। তারা এখন সংখ্যালঘুদের তালিকা ভুক্তিতে রয়েছে। চাঁদপুরের প্রভাবশালীরা বিভিন্ন ভাবে তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে ও নিজেদের নামে ভূমি বাসস্থান লিখে নিয়ে তাদেরকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে বলে হিন্দু নেতারা জানান। জনপ্রতিনিধি ও রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তিরা সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করার চেষ্ঠা করেও তারা করতে পারছেনা। চাঁদপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের, সংখ্যালঘু নেতা ও প্রান্তিকদের সাথে ব্যাপক ভাবে আলোচনায় জানাগেছে, চাঁদপুরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির হাজার হাজার মানুষের বসবাস রয়েছে। এরা সরকারি জায়গায় বা পৌরসভার সম্পত্তির উপর বসবাস করছে। তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের বসবাসকৃত সরকারি জায়গায় প্রায় দু’শ বছর যাবত বসবাস করে যাচ্ছে। তবে তারা এদেশের নাগরিক হিসেবে বসবাস করলেও তাদের স্থায়ীভাবে কোন জমিজামা নেই। তারা নির্ধারিত স্থানে বসবাস করতে হচ্ছে। সরকারি ভাবে ভূমিহীনদের জন্য তৈরী করা গুচ্ছ গ্রাম ও আশ্রয়ন প্রকল্পে এদেশের মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুরা বাসস্থান পেলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠি এ সহযোগীতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এদিকে সংখ্যালঘু হিন্দু নেতাদের সাথে ব্যাপক আলোচনায় বিভিন্ন তথ্য বের হয়ে আসে। এরমধ্যে সংখ্যালঘুদের জোড় পূর্বক উচ্ছেদ করা হচ্ছে মর্মে কেউ কেউ তাদের মতামত দিলেও আবার অনেকে বলেছে, সংখ্যালঘুরা ভারতকে তাদের নিরাপদ বসবাসের স্থান মনে করছে। এদেশের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকার সব সময় সংখ্যালঘুদের পাশে রয়েছে। যার ফলে এদেশের এমন কোন ব্যাক্তি নেই যে, সে জোর করে সংখ্যালঘুদের তাদের ভূমি ও বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করবে। সংখ্যালঘুরা এদেশে থাকার ইচ্ছা নেই বলে তারা দেশ ত্যাগ করছে। কেউ নিজের সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে চলে যাচ্ছে আবার অনেকে নিজের সম্পত্তি বিক্রি না করে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। এটা তাদের একান্ত ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। সংখ্যালঘু নেতারা এটাও মন্তব্য করেছেন যে, অনেক সংখ্যালঘু একই ভূমি একাধিক ব্যাক্তির নিকট বিক্রি করেও চলে যাওয়ার নজির রয়েছে। এছাড়া স্বাধীনাতার পূর্বে অনেকে দেশ ত্যাগ করলেও সে আর স্বাধীনতার পর নিজ ভূমি ও বাসস্থানে আসেনি। সে সম্পত্তি অনেক সংখ্যালঘু ভোগদখল করছে। আবার অনেকে ভুয়া দলিল সৃষ্টি করে বিক্রি করে চলে গেছেন ভারতে। সে কারনে এদেশে কথা উঠেছে সংখ্যালঘুরা দেশ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি সরকার রাষ্ট্রের আয়ত্বে নিয়ে এখন এদেশের প্রভাবশালীদের লিজ দেওয়ায় তারা ভোগদখল করে খাচ্ছে। এদেশের ভূমিহিন সংখ্যালঘুদের অভিযোগ তারা সে সম্পত্তি লিজ না পেয়ে সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তারা লিজ না পেয়ে সম্পত্তি ভোগ করতে পারছেনা বলে অনেক সংখ্যালঘু পরিবার অভিযোগ করেন। এর মধ্যে ব্যাপক আলোচনায় এমনও দেখা গেছে গ্রাম গঞ্জে বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়েছে। গ্রাম গঞ্জে একশ্রেণীর প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক ব্যাক্তিরা ও কিছু কিছু সংখ্যালঘু এদেশের মুসলিমদের সাথে এক জোট হয়ে অপর সংখ্যালঘুকে উচ্ছেদে বিভিন্ন ভাবে ধর্মীয়ানুভূতি কাজে লাগিয়ে উচ্ছেদে সহযোগীতা করেছে। এসব উচ্ছেদের ব্যাপারে ধর্মীয় অনুভূতির পাশাপাশি ব্যাক্তি শত্রুতাও কাজে লাগানো হচ্ছে সংখ্যালঘু উচ্ছেদে। সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদের ব্যাপারে জনপ্রতিনিধি ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা সব সময় সহযোগীতায় এগিয়ে আসছে বলে সংখ্যালঘুদের নেতারা জানান। তবে সংখ্যালঘুরা সব ক্ষেত্রে সহযোগীতা চায়না বলে তাদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে। এছাড়া এদেশের সংখ্যালঘুদের সংগঠন জেলা পর্যায়ে অনেক শক্তিশালী হওয়ায় সংখ্যালঘুদের সমস্যার কথা, ভূমি ও বাসস্থান সহ সকল ক্ষেত্রে তাদের নেতাদেরকে জানালে তারা তাৎক্ষনিক ভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের সমস্যা সমাধানে সোচ্ছার ভাবে কাজ করতে দেখে গেছে।
চাঁদপুরের প্রভাবশালী ও স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন কানাই চক্রবর্তী জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশে অনেক বিক্ষিপ্ত ঘটনাই ঘটেছে। এখন আর সে সব ঘটনা ঘটছেনা। চাঁদপুরে সংখ্যালঘু বলতে হিন্দুরা নিজেদেরকে মনে করছে না। গ্রামগঞ্জে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে পারিবারিক সমস্যা হতেই পারে। সেটাকে সংখ্যালঘু নির্যাতন বলে না। চাঁদপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা অত্যান্ত শান্তিতেই বসবাস করছে এবং প্রশাসনে সহযোগীতা পাচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি খোকন চন্দ্র দাস হরিজন জানান, এদেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদেই বসবাস করছে। তাদেরকে কেউ উচ্ছেদ করছে না। আমরা নিজেকে নিজে যদি দূর্বল মনে করি তাহলে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা আমাদেরকে উচ্ছেদ করার সুযোগ পায়। আমরা নিজেকে নিজে শক্তিশালী মনে করতে হবে। এসব উচ্ছেদের ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা ও অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা এর সাথে জড়িত থাকায় উচ্ছেদ হচ্ছে। তবে সংখ্যালঘুদের এদেশে থাকার ইচ্ছে নেই বলে তারা ভারত চলে যাচ্ছে। যদি থাকতে চাইতো কারো বাবার সাদ্য নেই সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করতে পারে। যারা চলে যাচ্ছে তারা ভারতকে নিরাপদ মনে করেই চলে যাচ্ছে ভারতে। শহরে সংখ্যলঘুদের উচ্ছেদে এ ধরনের ঘটনা তেমন একটা ঘটছেনা। গ্রামগঞ্জে প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক ও হিন্দু প্রভাবশালীরা বিভিন্ন ভাবে সহযোগীতা করে বলেই এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের হিন্দুরা তাদের ভূমি ও বাসস্থান ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের বসবাসে তেমন বাঁধা দেখছি না। জনপ্রতিনিধি ও সরকার সংখ্যালঘুদের সহায়তায় সবসময় এগিয়ে আসছে। তবে সংখ্যালঘুরা সহযোগীতা চায়না বলে তারা সহায়তা পাচ্ছেনা। সরকার সব সময় সংখ্যালঘুদের পাশে রয়েছে বলে আমার বিশ^াস। হিন্দু বৌদ্ধ-খৃষ্টান- ঐক্য পরিষদ নেতাদের নিকট সহায়তা চাইলে তারা তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা যেনে প্রশাসনের সহযোগীতা নিয়ে সংখ্যালঘুদের সকল কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর রেলওয়ে হরিজন কলোনির শ্রী শ্রী মহাবীর রাধা কৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক বিধান চন্দ্র দাস (জনি) জানান, চাঁদপুরে সংখ্যালঘুদের ভূমি ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাঁদপুর রেলওয়ে হরিজন কলোনির বসবাসরত লোকদের এ ধরনের কোন ভূমি বাসস্থান নেই। যার ফলে তাদের উপর উচ্ছেদের প্রভাব পরেনি। সংখ্যালঘুদের সাম্প্রদায়িক দিক বিবেচনা করতে গেলে বিভিন্ন চাপের কারনে বিশেষ ক্ষেত্রে ভূমি ও বাসস্থান ছেড়ে দেশান্তর হয়ে থাকতে দেখা যায়। এদেশের বিভিন্ন প্রভাবশালীরা ধর্মীয়ানুভুতি ও উগ্রতা সৃষ্টি করার কারনে সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদের মূল কারন হিসেবে উৎসাহ যোগাচ্ছে বলে আমি মনে করি। জনপ্রতিনিধিরা যে ভূমিকা নেয় তা পরিমানের ক্ষেত্রে অনেকটাই কম। সরকার বিভিন্ন ভাবে সংখ্যালঘুদের সহায়তা প্রদান সহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিরবতা পালন করায় সংখ্যালঘুরা সঠিক ভাবে সহযোগীতা পায়না। সংখ্যালঘুদের বিষয়ে বলতে গেলে বাংলাদেশের হিন্দু- বৌদ্ধ- খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ নামে একটি অরাজনৈতিক সু-শৃংঙ্খল একটি সংগঠন। এ সংগঠন থাকায় অনেক অত্যাচার ও বিভিন্ন নিপিড়িত সংখ্যালঘুদের পাশে সে সংগঠনের তাদের বিপদে সহযোগীতা দিচ্ছে। এ সংগঠনটি সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখছে। এ সংগঠন সরকারের সাথে অনেক বার সংখ্যালঘুদের অর্পিত সম্পত্তি রক্ষায় ট্রাইবুন্যাল গঠনে সরকারের সাথে সহযোগীতা করেছে এবং করে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে পুরান বাজার হরিজন কলোনির যুব ক্লাবের সভাপতি শ্যামল দাস হরিজন জানান, সংখ্যালঘুদের পূর্ব পুরুষের যে জমি ছিলো তারা তা ফেলে রেখে ভারতে চলে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। দীর্ঘদিন ও বছরকে বছর পরে থাকায় সরকার সে সম্পত্তির টেক্স, পানি ও বিদ্যুৎ বিল সহ বিভিন্ন খাজনা থেকে বঞ্চিত হয়। তারা এ দেশে থাকলে সরকার তাদের কাছ থেকে বিরাট অংকের রাজস্ব পেত। যুগ যুগ ধরে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি পরে থাকায় সরকার এ সম্পত্তি সরকারি কোষাঘারে নিয়ে যায়। সরকার বিভিন্ন মানুষকে বর্তমানে সে সম্পত্তি ভোগ দখল করার জন্য লিজের মাধ্যমে হস্তান্তর করে। তবে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় হিন্দুরা এ দেশে নির্যাতিত বেশি হয়েছে। বর্তমানে কিছু কিছু জেলায় এ ধরনের ঘটনা এখনো সংখ্যালঘুদের উপর হচ্ছে। স্বাধীনতার সময় বেশি নির্যাতিত হওয়া সংখ্যালঘুরা জীবন বাঁচাতে তাদের বাসস্থান ও ভূমি ফেলে রেখে ভারত চলে যায়। সে ভয়ে স্বাধীনতার পরেও তারা তাদের বাসস্থান ও ভূমিতে আসতে সাহস পাচ্ছে না। অনেকে তাদের ভুমি ও বাসস্থান বিক্রি করে চলে যায়। প্রভাবশালী চক্র এবং কুচক্রি মহল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করার কারনে হিন্দুরা তাদের সম্পত্তি ফেলে রেখে চলে যায়। জনপ্রতিনিধিরা সঠিক ভাবে কাজ করছে না এদের জন্য। যদি সঠিক কাজ করতো তাহলে এদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য মঙ্গল হতো। সরকার সংখ্যালঘুদের সকল ক্ষেত্রে সহযোগীতা করছে। কিন্তু প্রশাসন তা সঠিক আইনের মাধ্যমে করলে সংখ্যালঘুরা প্রকৃত ভাবে উপকৃত হতো। সংখ্যালঘু সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের সমস্যার কথা জানানো হলেই সংগঠন তড়িৎ ভাবে এগিয়ে এসে তাদের সহায়তায় চেষ্ঠা করে।