চাঁদপুর জেলাধীন কচুয়া উপজেলার ‘‘ সাচার ’’ একটি ঐতিহাসিক স্থান। এশিয়ার বিখ্যাত কারুকার্য্য খচিত দৃষ্টি নন্দন সাচার রথ সারা বাংলাদেশে সাচারকে দিয়েছে বিশেষ পরিচিতি। হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটিও রথ ও জগন্নাতের সুবাদে হিন্দু সম্প্রদায়ের তির্থস্থান হিসাবে পরিচিত।
কচুয়া উপজেলা থেকে ১৪ কি:মি: উত্তরে কচুয়া গৌরীপুর রাস্তার পাশেই অবস্থিত, ব্যবসা বানিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র ‘‘সাচার বাজার’’। বাজারের পশ্চিম পাশেই সবুজ গাছগাছালীতে ভরা ছায়াঘেরা আমাদের সকলের প্রিয় সাচার গ্রাম। পূর্বে সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা গোগরারবিল, উত্তর পাশে একটি ছোট নদী। এই নদীর দক্ষিণ পাড়ে গ্রামীন জনপদে প্রাচীনকালে কখন যে এই বাজার গড়ে উঠেছিল, তার সঠিক তথ্য প্রমান জানা না গেলও স্থানীয় অধিবাসীদের অভিমত অনুসারে ২২১ বৎসর আগে ইংরেজ শাসন আমলে
সম্ভবত: ১৭৯৩ সালে নৌ যাতায়াতের সুবিদার্থে ৪টি সু-বিশাল বটগাছকে কেন্দ্র করে এই বাজারটি গড়ে
উঠেছিল। আর এই তথ্যটিই সত্য বলে মনে করেছে সর্ব মহল। ঐ আমলে দুরদুরান্ত থেকে আগত মানুষ উত্তর বাজারে নদীর দক্ষিণ পাড়ে বটগাছের আশেপাশে নৌকায় নৌকায় বেচাকিনা করত। সময়ের পরিবর্তনে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি হওয়ায় ঐ দৃশ্য এখন আর নাই। সময়ের বিবর্তনের ফলে বাজরটি তিনভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর বাজার,দক্ষিণ বাজার ও মধ্য বাজারে রূপান্তরিত হয়েছে। বাজারের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য বটগাছগুলির যে আকর্ষন ছিল তার অস্তিত্ব এখন আর নেই। ১০-১৫ বছর আগে বয়সের ভারে, ঝড়-তুফানে ডালপালা ভেঙ্গে যায়, পরে শুকিয়ে গাছগুলি মরে কালের অতল গহবরে চিরতরে বিলিন হয়ে যায়।
অন্যদিকে সাচার গ্রামের উত্তর পশ্চিম পাশেই সুয়ারোল গ্রাম ও বাজার। এককালে যোগাযোগ বিছিন্ন অজোপাড়া গাঁ ছিল। কিন্তুু জৈনপুরীদের আগমন ও অবস্থানের কারনেই এই বাজারটি আলোচিত ও প্রতিষ্ঠিত। এটা বলাই বাহুল্য যে, যুগেযুগে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য আরব মূল্লুুকসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে অনেক পীর, ফকির, দরবেশ, অলীয়ে কামেল সুফী সাধক এই দেশে এসেছিলেন।
তবে, ভারত থেকে ইসলাম প্রচারে সর্ব প্রথম আগমন করেন,পীরে কামেল হযরত মাওলানা কেরামত আলী সাহেব, তারপর আসেন তারই উত্তরসূরী অলীয়ে কামেল হযরত মাওলানা আব্দুল মবিন সাহেব। একটি বাস্তব ও সত্য ঘটনার অবতারনা থেকেই এই গল্পের সুচনা:-
ব্রিটিশ শাসন আমল। তৎকালিন সাচারের দুর্দন্ড প্রতাপশালী জমিদার দূর্গাপ্রসাদ সেন। তারই জমিদারী এলাকা সাচার বাজারে ভারতের জৈনপুর থেকে আগমন করেন হযরত মাওলানা আ: মবিন সাহেব। যথানিয়মে তিনি বাজারের উত্তর দিকে ছোট নদীতে তাহার বজরা (নৌকা) নোঙ্গর ফেলে উত্তর বাজারে মনুমিয়ার ঘরে অবস্থান গ্রহণ করেন। সময়টি ছিল ১৯৪০ইংরেজী, বাংলা ফালগুন মাস।
জৈনপুরীদের অবস্থান ও আগমনে আশে পাশের গ্রাম থেকে তাহার মুরিদ, ভক্তবৃন্দ ও আশেকানগণ এখানে আসতে শুরু করে। তিনি তাহার মুরিদ ও ভক্তবৃন্দের মাঝে ইসলাম ধর্মের নীতি নৈতিকতা ও আদর্শ প্রচার করতে করতে এই বাজারে একটি মাহফিল করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং নির্ধারিত তারিখে উত্তর বাজারের বটগাছের পশ্চিম পাশজুড়ে ওয়াজ মাহফিল আরম্ভ করেন।
নদীর উত্তরপাড় ২টি গরু জবাই করে, আগত লোকজনের মাধ্যে তবারক বিতরনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তুু বিধি বাম! বাজারের অধিকাংশ দোকানদার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের, তার উপর হিন্দু জমিদার দূর্গাপ্রসাদ সেন। তারই জমিদারী এলাকায় গরু জবাই এর খবর শুনে, বাজারের সমস্ত দোকানদারকে মুসলমানদের নিকট মাহফিলে হলুদ, মরিচ, লবন, পেয়াজ, রসুন,আদা, তৈল, মশলা ইত্যাদি বিক্রি নিষিদ্ধ করেদেন এবং যারা তাদের নিকট (মুসলমানদের) মালামাল বেচাবিক্রি করবে তাদের দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষনা দেন। ভয়ে বাজারের দোকানদারগণ দোকান বন্ধ করে হরতাল পালন করে।
উপায়ান্ত না দেখে হযরত মাওলানা মবিন সাহেব রাতারাতি লোক পাঠাইয়া ৬ মাইল দুরে ইলিয়টগঞ্জ বাজার থেকে আদা, লবন, হলুদ, মরিচ, পেয়াজ, রসুন, তৈল, মশলা এনে মাংশ পাকানো এবং তবারক বিতরন করে মাহফিল শেষ করেন। হিন্দুসম্প্রদায়ের অনাকাংখিত আচরন ও সাম্প্রদায়িক এই পরিস্থিতির কারনে মাওলানা মবিন সাহেব মনক্ষুন্ন হয়ে রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে বজরায় আরোহন করেন এবং প্রভাত হওয়ার পূর্বেই সুয়ারোল নামক স্থানে বজরা নোঙ্গর ফেলে অবস্থান নেন।
তিনি ফজরের নামাজ আদায় করে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করেন। চুম্বকের আকর্ষনে লোহা যেমন কাছে আসে, তদ্রুপ জৈনপুরীদের প্রতি মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালভাসা, আবেগ অনুভুতির আকর্ষনে সকাল হওয়ার সাথে সাথেই চতুরদিক থেকে মানুষ পঙ্গপালেরমত দলে দলে দোকানপাটনিয়া সোয়ারোলের দিকে আসতে আরম্ভ করে।
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আশে পাশের এলাকা লোকে লোকারন্য হয়ে গেল। মাছ, মাংশ তরি তরকারি, শাক সবজি, ডিম দুধ পেয়াজ, রসুন, হলুদ, মরিচ, লবন তৈল মসলার বিভিন্ন দোকান সাজিয়ে মানুষ বেচাকিনা আরম্ভ করে দিল। সুয়ারোল একটি অস্থায়ী বাজারে পরিনত হল। শমশের উদ্দিন প্রধানিয়া হযরত মাওলানা মবিন সাহেব এবং বাজারের জন্য স্থায়ী জায়গা দিলেন। বর্তমানে এখানে জৈনপুরীদের খানকা মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানা গড়ে উঠেছে। জৈনপুরীদের এইসব স্মৃতি কালের স্বাক্ষী হিসাবে চিরদিন ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।
তৎকালীন সময়ে সুয়ারোলে শনি, মঙ্গল বারে বাজার বসত, বর্তমানে সোম ও বৃহস্পতিবার বাজার বসে। অন্য দিকে সাচার বাজারে লোকজন নাই, বহুদিনের পুরানো বাজার নিরব নি:স্তব্ধ নির্জনপুরীতে পরিনত হল। লোকজন সাচার বাজারে যাতায়াত বন্ধ করে সুয়ারোল বাজারে যাতায়ত আরম্ভ করল। বাজার ভেঙ্গে গেল। জমিদার শতচেষ্টা করেও সুয়ারোল বাজারে লোক যাতায়ত বন্ধ করতে পারলনা। সাচার বাজার থেকে পশ্চিম দিকে শুয়ারোল যাতায়াতের সব রাস্তা বন্ধ করে জায়গায় জায়গায় চেকপোষ্ট (পাহারার ব্যবস্থা) বসালো, যাতে পূর্ব দিকের কোন লোক পশ্চিমে দিকে শুয়ারোল বাজারে যাইতে না পারে। তবুও সাচার বাজারে লোক ধরে রাখতে পারলেন না। প্রথম অবস্থায় হিন্দু দোকানদারগণ শুয়ারোল বাজারে যায় নাই, পরে যখন তারা (হিন্দু দোকানদার) দেখল এই বাজারে (সাচার) বেচাকেনা নাই, লোকজনও আসেনা, কিছুদিন পর তারাও (হিন্দু দোকানদার) সাচার বাজারের সমস্ত ব্যবসা গুটিয়ে সুয়ারোল বাজারে গেল এবং স্থায়ীভাবে ব্যবসা আড়ম্ভ করল।
জমিদারের ভুলেরজন্য এবং হিন্দুদের অনড় অবস্থানের কারনে, র্দীঘদিনের পুরানো বাজার এখন ভাঙ্গা বাজারে রূপনিল। জমিদার দূর্গাপ্রসাদ সেন তাহার আত্মঅহংকার, প্রভাব প্রতিপত্বি, বিত্তবৈভব ও ক্ষমতার দাপটে মুসলমানদের দমানো এবং শায়েস্তা করার জন্য গরু জবাই ও বাজার ভাঙ্গার অজুহাতে শান্তি প্রিয়, নির্দোষ, নিরপরাদ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় অলীয়ে কামেল হযরত মাওলানা আব্দুল মবিন সাহেব এবং সাচার ও অত্র এলাকার সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিতসর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ১। মৌলভী: ইমাম উদ্দিন, রাগদৈল ২। মৌলভী আ: মজিদ, বিতারা ৩। মো: নজমদ্দিন সরকার, বড়দৈল ৪। মো: মনু মিয়া তালেরছেও ৫। মো: আয়েত আলী ভূঁইয়া, কলাকোপা (সাচার) ৬। মো: আলী মিয়া প্রধানিয়া, বেরকোটা ও ৭। মো: জাফর আলী প্রধানিয়া, মালীগাঁও। এই ৭জনসহ সর্বমোট ৮ জনকে আসামী করে চাঁদপুর মহাকুমা মেজিষ্টেট কোর্টে একটি ষড়যন্ত্রমুলক মামলা দায়ের করেন। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি গ্রহণ না করায়,সেন মহাশয় তৎকালীন ত্রিপুরার বর্তমান কুমিল্লা আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। কুমিল্লা আদালতেও হযরত মাওলানা আবদুল মবিন সাহেবসহ অন্যান্য ৭জনও মিথ্যা যড়যন্ত্রমুলক মামলা থেকে অব্যাহতি পান। ২ বৎসর মামলা চালাইয়া যখন সেন মহাশয় কোন ভাবেই মুসলমানদেরকে দমাইতে বা শায়েস্থা করতে পারলেন না। তখন জমিদার দূর্গাপ্রসাদ সেন লজ্জায়, অপমানে, ক্ষোভে দু:ক্ষে যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পরেন। ৩/৪ বৎসর পর তিনি ইহদাম ত্যাগ করে পরলোক গমন করেন।
এরি মধ্যে বৃটিশ শাষনের বিদায় ঘন্টা বেজে গেল। বৃটিশ বেনিয়াদের অপশাসনের অবসান ঘটলো ১৯৪৭ সালে পাকিস্থান সৃষ্টি হইল। দূর্গা প্রসাদ সেনের ওয়ারিশদের মধ্যে ৩ ছেলে ভারতের কলিকাতা
চলে গেলেন। তার অনেক দিন পর অপর ২ ছেলেই চিরকুমার এদেশেই পরলোক গমন করেন। সাচারে জমিদারের কোন বংশধর আজ আর সাচারে না থাকলেও জমিদার বাড়ীর জরাজীর্ন দালান কোঠা, শানবাধাঁনোঘাট, দীঘিপুকুর, রথ ও জগন্নাথমন্দির আজও তাদের অতিত ইতিহাসের প্রতীকি স্বাক্ষর বহন করে। বেশ কিছুদিন পর ১৯৫২সালে তৎকালীন পাথৈর (পূর্ব) ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আয়েত আলী ভূঁইয়া, ও সাচার বাজার সেক্রেটারী মনুমিয়া, আলী মিয়া প্রধানিয়া এবং এলাকার সমস্ত হিন্দু সম্প্রদায়কে সাথে নিয়া হযরত মাওলানা আব্দুল মবিন সাহেবের হাত পা ধরে জমিদার ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে মাওলানা আব্দুল মবিন সাহেবকে আবার সাচার বাজারে আনেন ও হযরত মাওলানা আবদুল মবিন সাহেব এর কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন। ফলে নতুনভাবে সাচার বাজার পু:ন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হযরত মাওলানা মবিন সাহেবের দোয়ায় প্রতি শনি, মঙ্গলবার সাচার বাজার এবং রবি ও বৃহস্পতিবার সুয়ারোল বাজার মিলানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর পর থেকে সাচার বাজার আবার পুরোদমে নতুনভাবে শুরু হয় এবং আজকের জাকজমকপূর্ন অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
বাজার পুনরায় সাচারে পু:ন প্রতিষ্ঠিত হলেও তখনথেকে শুয়ারোল বাজারে প্রতিবছর মাঘ, ফালগুন মাসে জৈনপুর হুজুরের মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এলাকার জনসাধারণ স্বতস্ফুর্ত ভাবে টাকা পয়সা গরু, মহিষ দিয়ে সহযোগিতা করছে এবং একইভাবে জৈনপুরীদের ইসলামের নীতি আদর্শ প্রচারের ধারা যেমন অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
লেখক পরিচিত ঃ ডা: এম,এ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কুমিল্লাস্থ কচুয়া সমিতি এবং স্বত্ত্বাধিকারী কুমিল্লা ডেন্টাল, গ্রাম- হাতিরবন্দ, কচুয়া, চাঁদপুর।
শিরোনাম:
বুধবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ৭ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।