ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম ১৫ অক্টোবর ১৯৩১ সালে ভারতের তামিলনাড়ুতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে বিজ্ঞানী, অধ্যাপক ও লেখক। চলতি বছরের ১ মার্চ তিনি সোলাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এই বক্তব্য দেন।
‘সোলাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে আসতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমি খুশি যে, সোলাপুর বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখন এখানে ২১টি বিভাগ রয়েছে। সেই সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১২৬টি কলেজ রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৮৯ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। মহারাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেসব ব্যক্তি এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, পরিচালনা করছেন, তাঁদের জানাই অভিনন্দন। আজ মহারাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্মের মাঝে আসতে পেরে তাদের নিজেকে বদলে ফেলা, সবার চেয়ে আলাদা করে গড়ে তোলার বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিতে চাই। সবার চেয়ে আলাদা; সেটাই তুমি। তোমরা সবাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছ। তোমাদের প্রত্যেকের চোখে স্বপ্ন এমন কিছু করার, যাতে সবাই তোমাকে মনে রাখে। তবে আমার কথা শোনো, সবাই তোমাকে তখনই মনে রাখবে, যখন তুমি সবার চেয়ে আলাদা কিছু করবে।
তোমাকে সবার চেয়ে আলাদা হতে হবে, অনন্য হতে হবে। কী সিদ্ধান্ত নিলে তোমরা ২০১২ সালে এমন কিছু করবে, যা হবে সবচেয়ে আলাদা। আচ্ছা চলো, আজ বরং তোমাদের এমন কিছু মানুষের গল্প শোনাই, যাঁরা সবার চেয়ে আলাদা কিছু করে সবার মাঝে স্মরণীয় হয়ে আছেন আজও। বন্ধুরা, বৈদ্যুতিক বাতির দিকে তাকাও। কী ওটা, দেখামাত্র নিশ্চয় টমাস আলভা এডিসনের কথা মনে পড়েছে। সেটাই হওয়ার কথা। কারণ, তিনি অনন্য একটা কাজ করেছিলেন; বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। যখন বাড়ির ওপর দিয়ে বিমান উড়ে যেতে দেখো, তখন নিশ্চয় রাইট ভাইদের কথা মনে পড়ে। কারণ, নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে মানুষ উড়তে পারে। টেলিফোনের কথা উঠলে কার নাম মাথায় আসে? নিশ্চয় অ্যালেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের নাম। যখন সবাই সমুদ্র পাড়ি দেওয়াটাকে দুঃসাধ্য ভাবত, তখন সমুদ্র আর আকাশের মিলনস্থল নীল কেন, তা চিন্তা করেছিলেন স্যার সি ভি রমন। নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। তোমরা নিশ্চয় গণিতবিদ রামানুজানের নাম শুনেছ। গণিতের ইতিহাসে তাঁর অমূল্য অবদানের কথা কে না জানে? বন্ধুরা, সেই মহান নারী বিজ্ঞানীর কথা নিশ্চয় মনে আছে তোমাদের। তিনি একটা নয়, দু-দুটো নোবেল পেয়েছিলেন। একটা পদার্থবিজ্ঞানে, আরেকটা রসায়নে। তিনি হলেন মাদাম কুরি। মাদাম কুরি তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। এবং তিনি মানবদেহের ওপর রেডিয়ামের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। যে রেডিয়াম তিনি নিজে আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁর তেজস্ক্রিয় প্রভাবেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মানুষকে ব্যথামুক্ত জীবন দিতে গিয়ে নিজে অবর্ণনীয় ব্যথা সহ্য করেছিলেন। আমি দেখেছি, আমি যেখানেই কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের কথা বলি, তোমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠো। আমি এক কোটির বেশি তরুণের সামনে কথা বলেছি দীর্ঘ সময়। তাদের প্রত্যেকেই সবার চেয়ে আলাদা, অনন্য হতে চায়। কিন্তু গোটা পৃথিবী তার সেরাটা দিয়ে যাচ্ছে সব সময়, তোমাকে আর সবার মতো সাধারণ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে পৃথিবীটা। এই যেমন ধরো, তোমার মা-বাবা সারা জীবন তোমাকে বলে এসেছেন পাশের বাসার ভালো ছাত্রটির মতো হতে। স্কুলে যখন গিয়েছ, শিক্ষক বলেছেন, প্রথম পাঁচ রোলের মধ্যে যারা আছে, তাদের মতো হতে। যেখানেই যাও না কেন, সেখানেই সবাই বলতে থাকবে, অন্য কারও মতো হতে অথবা অন্য সবার মতো হতে। এর পরও তোমাদের মধ্যে কতজন একেবারে অন্য রকম হতে চাও, বলো আমাকে। এটাই চ্যালেঞ্জ। কঠিন যুদ্ধে নামতে হবে তোমাকে। অবিরত জ্ঞানার্জন, কঠিন পরিশ্রম ও লক্ষ্য পূরণের সংকল্প—এসব থাকতেই হবে। কিছুদিন আগে আমি একটা বই পড়ছিলাম। তা থেকে একটা ঘটনা শোনাব এখন। মেক্সিকোর এক কারাগারে, একে তো দাঙ্গা চলছিল, ২৫ হাজার কয়েদিকে রাখা হয়েছিল, যদিও ওটার ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র ৬০০ জনের। কয়েদিরা পুলিশের ওপর হামলা করছিল, পুলিশ গুলি চালাচ্ছিল নির্বিচারে। সব থামলে অনেকক্ষণ পর ৬৩ বছর বয়স্ক এক নারী হাত তুলে সবার মাঝে এসে দাঁড়ালেন। সবাইকে থামতে বললেন। এবং আশ্চর্যের কথা, সবাই তা মেনে নিল! কারণ আর কিছুই না। কারণ হলো, ওই বৃদ্ধা ছিলেন সেই নারী, যে কিনা নিজের সারা জীবন উজাড় করে কয়েদিদের খাবার-দাবার, যত্ন করে চলেছেন। শান্তির সঙ্গে সবাইকে ভালো হওয়ার কথা বলেছেন। হাজার হাজার খুনি, অপরাধীর মাঝেও একজন সৎ নেতা হয়ে উঠেছিলেন ওই বৃদ্ধা। এমন অসংখ্য নেতা চাই আমাদের এই বিশ্বের নিরুপায় মানুষের জন্য। বিজ্ঞান তোমাদের কী দিতে পারে? বিজ্ঞান তোমাকে অনেক কিছুই দিতে পারে। বিজ্ঞানী হওয়ার অনেক মজা। তোমার বন্ধুরা সময়ের হিসাব করবে বড়জোর সেকেন্ডে, আর তুমি তা করতে পারবে সেকেন্ডের কোটি কোটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে, ফেমটো সেকেন্ডে। বিজ্ঞানী হলে নিজেকে আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটনের কাতারে ভাবতে পারবে। কোন জিনিসগুলো তোমাকে উদ্ভাবক ও অনুসন্ধিৎসু করে তুলতে পারে জানো? এমন তিনটি জিনিস আছে। সেগুলো হলো ভালো বই, ভালো মানুষ ও ভালো শিক্ষক। আর সেই সঙ্গে উন্মুক্ত চিন্তাধারা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে। কিছুদিন আগে আমি হার্ভার্ডে গিয়ে দেখেছি, ওখানে এমন একটা ন্যানো সুচ তৈরি হয়েছে, যা দিয়ে কিনা একটা অতি ক্ষুদ্র কোষেও প্রয়োগ করা যাবে ওষুধ। বিজ্ঞান থেকে প্রযুক্তি আলাদা রাখলে চলবে না। শিক্ষার্থীরা, তোমরা শিক্ষার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথে নেমেছ। মনে রেখো, শ্রেষ্ঠত্ব এমনি এমনি আসে না। এটি একটা কঠিন প্রক্রিয়া। নিজের লক্ষ্য ঠিক রেখে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রিত ঝুঁকি নিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। প্রতিযোগিতাটা অন্য কারও সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে। এটাই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথ। আমি এখানেই আমার বক্তব্য শেষ করছি। সোলাপুরের শিক্ষার্থীদের প্রতি রইল আমার শুভ কামনা।’
সূত্র: ওয়েবসাইট