
২০২৫ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ফলাফলে ধস নেমেছে। পাস করেছেন মাত্র ৫৮.৮৩ শতাংশ পরীক্ষার্থী। যা গত বছরের তুলনায় ১৮.৯৫ শতাংশ কম। সেইসঙ্গে ১৯ বছরের তুলনায় এবারের পাসের হার সর্বনিম্ন্ন। পাসের হারের পাশাপাশি কমেছে সর্বোচ্চ ফল জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যাও। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন মাত্র ৬৯ হাজার ৯৭ জন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। বছরের ব্যবধানে কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন। গত কয়েক বছর ধরেই এইচএসসি ও সমমান পাসের হার ছিলো ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। যা আওয়ামী লীগ সরকার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করতো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন কোনো গ্রেস মার্ক না দেয়াতেই এ রকম ফল। সেইসঙ্গে তারা এটাকে প্রকৃত ফল বা বাস্তব চিত্র বলছেন।
বৃহস্পতিবার চলতি বছরের ফল ৯টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ফল প্রকাশিত হয়। পরীক্ষায় অংশ নেয়া ১২ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪১.১৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী ফেল করেছেন। ২০০৫ সালে গড় পাসের হার ছিল ৫৯.১৬। অর্থাৎ দীর্ঘ ১৯ বছরের তুলনায় এবারের পারে হার কম। এ বছর গড় পাসের হার ৫৮.৮৩। বিগত ১০ বছরের ফলে দেখা যায় ২০১৬ সালে পাসের হার ছিল ৭৪.৭০, ২০১৭ সালে ৬৮.৯২, ২০১৮ সালে ৬৬.৬৪, ২০১৯ সালে ৭৩.৯৩, ২০২০ সালে ১০০ (অটোপাস), ২০২১ সালে ৯৫.২৬, ২০২২ সালে ৮৫.৯৫, ২০২৩ সালে ৭৮.৬৪, ২০২৪ সালে ৭৭.৭৮ শতাংশ।
চলতি বছরের ফলে দেখা যায়, মানবিক বিভাগের পরীক্ষার্থীরা ৫১.৫৫ শতাংশ ফেল করেছেন। মানবিক বিভাগ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৯৪৯ জন। তাদের মধ্যে পাস করেছেন ৬৫ হাজার ২৫০ জন। বিজ্ঞান বিভাগে মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ৯৪ হাজার ৯৭ জন। তাদের মধ্যে পাস করেছেন ৮০ হাজার ৭৬১ জন, পাসের হার ৮৫.৮৩ শতাংশ। ব্যবসায় শিক্ষা বা বাণিজ্য বিভাগে মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ৬৬ হাজার ১১৪ জন। পাস করেছেন ৪২ হাজার ৭৭২ জন, পাসের হার ৬৪.৬৯।
সর্বোচ্চ পাসের হার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ৭৫.৬১। এরপর রয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ৬৪.৬২ শতাংশ। সব থেকে কম পাসের হার কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে, ৪৮.৮৬। বোর্ডগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৫২.৫৭, রাজশাহীতে ৫৯.৪০, যশোরে ৫০.২০, বরিশালে ৬২.৫৭, সিলেটে ৫১.৮৬, দিনাজপুরে ৫৭.৪৯, ময়মনসিংহে ৫১.৫৪ শতাংশ।
অধিকাংশ বোর্ডের ফল বিপর্যয়ের প্রধান কারণ ইংরেজিতে কম নম্বর পাওয়া। ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে ৭৩.৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে ৬৫.২৮ শতাংশ, রাজশাহীতে ৬৮.৮২, যশোরে ৫৪.৮২, চট্টগ্রামে ৬৩.৭৬, সিলেটে ৬৪.৫৩, দিনাজপুরে ৬৪.৪৭ এবং ময়মনসিংহে ৬১.৯২। ইংরেজিতে সবচেয়ে ভালো করেছেন বরিশাল বোর্ডের শিক্ষার্থীরা (৭৫.১৬ শতাংশ)।
এবার সবথেকে বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছেন ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। এই বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৬ হাজার ৬৩ জন। এছাড়া রাজশাহী বোর্ডে ১০ হাজার ১৩৭ জন, দিনাজপুরে ৬ হাজার ২৬০ জন, চট্টগ্রামে ৬ হাজার ৯৭ জন, যশোরে ৫ হাজার ৯৯৫ জন, মাদ্রাসায় ৪ হাজার ২৬৮ জন, কুমিল্লায় ২ হাজার ৭০৭ জন, ময়মনসিংহে ২ হাজার ৬৮৪ জন, বরিশালে ১ হাজার ৬৭৪ জন, কারিগরিতে ১ হাজার ৬১০ জন ও সিলেট বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৬০২ জন।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ফল ভালো করেছে ছাত্রীরা। পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬ জন। আর ছাত্র ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৪ জন। ছাত্রীদের গড় পাসের হার ৬২.৯৭ এবং ছাত্রদের ৫৪.৬০ শতাংশ। জিপিএ-৫ পাওয়া ৬৯ হাজার ৯৭ জনের মধ্যে ছাত্রী ৩৭ হাজার ৪৪ জন এবং ছাত্র ৩২ হাজার ৫৩ জন।
চলতি বছরে দেশের ৩৪৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৮৮টি। সে হিসাবে এবার শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান কমেছে ১ হাজার ৪৩টি। সারা দেশের ২ হাজার ৮০০টি কেন্দ্রে মোট ৯ হাজার ৩০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নেন। ২০২টি প্রতিষ্ঠানে কেউই পাস করতে পারেননি। এবার দেশের বাইরেও ৮টি কেন্দ্রে মোট ২৯১ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেন। পাস করেছেন ২৭৯ জন। গড় পাসের হার ৯৫.৮৮। ফল নিয়ে অসন্তুষ্ট শিক্ষার্থীরা পুনঃনিরীক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবেন ১৭ই অক্টোবর থেকে ২৩শে অক্টোবর পর্যন্ত। অনলাইনে এই প্রতিটি পত্রের জন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫০ টাকা।
ফল প্রকাশের সময় আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, বিগত ফলাফলগুলোয় গলদ ছিল। এবারের ফলাফল থেকে এটিই প্রতীয়মান হয়। ভুল লিখলেও ১, ২ দিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই, এ বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে খুশি। বোর্ডের পক্ষ থেকে নির্দেশনা না পেয়ে পরীক্ষকরাও আনন্দিত। তারা ভালো খাতা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এসএসসির পর এইচএসসি’র ফলাফল দিলাম। কাউকে ছক বেঁধে দিইনি যে, ছাড় দিয়ে পাসের হার বাড়াবেন। এমন ভাবনা থাকার প্রয়োজন নেই। সরকারের নির্দেশনা ছিল, নিয়ম মেনেই সব হবে।
এছাড়াও সচিবালয়ে ফলাফল সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সিআর আবরার বলেন, বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল অনেককে বিস্মিত করেছে। পাসের হার এবং জিপিএ-৫ সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় কম এবং প্রশ্ন উঠেছে কেন? এর উত্তর জটিল নয়, বরং সহজ, কিন্তু অস্বস্তিকর। বাংলাদেশে শেখার সংকট শুরু হয় খুব শুরুর দিকেই। প্রাথমিক স্তর থেকেই শেখার ঘাটতি তৈরি হয়। আমরা দীর্ঘদিন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চাইনি। আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছিল পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক, জিপিএ-৫ এর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মানদণ্ড। ফলাফল ভালো দেখাতে গিয়ে আমরা অজান্তেই শেখার প্রকৃত সংকট আড়াল করেছি। আজ আমি সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই। একজন দায়িত্বশীল হিসেবে আমি চাই, শিক্ষাব্যবস্থা আবার বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করুক। যে ফলাফল শিক্ষার্থীর শেখাকে সত্যিকারের মূল্যায়ন করে, সেটিই হোক আমাদের সাফল্যের মানদণ্ড।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, এসএসসি ফলাফল প্রকাশের পর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যে উদ্বেগ উঠেছিল, আমি তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছি। আমি সকল শিক্ষা বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছি যেন ভবিষ্যৎ পরীক্ষায়, বিশেষ করে এইচএসসি মূল্যায়নে, সীমান্তরেখায় থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি সর্বোচ্চ ন্যায্যতা বজায় রাখা হয়, কিন্তু একই সঙ্গে যেন ফলাফলের বাস্তবতা বিকৃত না হয়। আমরা ‘অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি’ নয়, বরং ‘ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততা’কে বেছে নিয়েছি।
