সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম
“যুগান্তর ”, মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০১৪ এর শেষ পাতায় মাননীয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার “ জনাব বেনজীর আহমেদ” কে নিয়ে লেখা একটি রিপোর্ট এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে “জনাব বেনজীর আহমেদ” এর একটি বক্তব্য আমাকে পিছনে ফেলে আসা কয়েকটি ঘটনা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে । সামান্য কয়েকটি কথা কিন্তু এর তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ ব্যাপক হতে পারে –
” নিজের স্বামী কিংবা ভাইকে কেউ খারাপ বলে না । এসব ছিনতাইকারী বাইরে কি করে সেটি তারা বাসায় গিয়ে বলে না । রোববার ভোর রাতে যে দুইজন ছিনতাইকারী নিহত হয়েহে তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে । এসব আপরাধীদের যথাযথ শাস্তি দিয়ে ঢাকা কে সেভ করা হবে । ঢাকা ‘ র মানুষদের নিরাপদে রাখা হবে ———-” ।
চারিদিকে আনেক বিভ্রান্তির মধ্যেও কারো কারো অথবা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু আন্তরিক সেবামূলক কর্মকাণ্ড সবার কাছে দৃষ্টি নন্দন, প্রশান্তি দায়ক । ঠিক তেমনি বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান “ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ” অনেক সামাজিক সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের প্রশংসনীয় ভাবে সম্পৃক্ত করেছে । নিঃসন্দেহে সবার আনেক প্রশংসার দাবিদার এই প্রতিষ্ঠান ।
মাননীয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কশিশনার “জনাব বেনজীর আহমেদ” ঢাকাকে কতটুকু সেভ করবেন জানিনা , ঢাকার মানুষরা কতটুকু নিরাপদে থাকবে তাও জানিনা তবে তাঁর যে কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ সেটি হচ্ছে “নিজের স্বামী কিংবা ভাইকে কেউ খারাপ বলে না । এসব ছিনতাইকারী বাইরে কি করে সেটি তারা বাসায় গিয়ে বলে না ।” মাত্র কয়েকটি কথা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে কয়েকটি বাস্তব ঘটনাকে –
২০০০ সালে কর্পোরেট দুনিয়া ছেড়ে আমি পুরোপুরি আমার বর্তমান পেশাতে ঢুকে পড়ি । প্রথমে সিনিয়রের সাথে কাজ শুরু করি । সিনিয়রকে সাহায্য করার জন্য প্রথমেই আমার উপর দায়িত্ব এসে পড়ে একটি “মার্ডার কেইস”। ভয়ংকর এক খুনি , একসাথে দুইজনকে পরিকল্পনা করে খুন করেছে ” আনেকদিন ধরে আপরাধ জগতের সাথে জড়িত , আনেক রকম মামলার বোঝা মাথার উপর । পরিবারের কেউ কিছু জানত না এবিষয়ে কিন্তু এবার আর গোপন থাকেনি কিছু।
তাকে হাত পায়ে বেড়ী বাঁধা শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কেইসের তারিখে তারিখে কোর্ট এ হাজির করা হয় । আমার হাতে থাকে ফাইল , আমার পিছে পিছে থাকে সেই ভয়ংকর খুনি’র মমতাময়ী মা’ আর প্রিয়তমা স্ত্রী । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি ছেলের জন্য মমতাময়ী মা’র বুক ফাটা আর্তনাদ । প্রিয়তমা স্ত্রী’র বুক ভেসে যায় আশ্রুধারাতে। তাদের হাতে থাকা প্যাকেটে সযত্নে রান্না করা আনেক রকম খাবার। বেড়ী বাধা হাতে সেই খাবার নিজের হাতে মা’কে, স্ত্রীকে মুখে তুলে সযত্নে খাইয়ে দেয় সেই ভয়ংকর খুনি, তার দু চোখেও অঝোর অশ্রুধারা তার পরিবার এর জন্য ।
তখনও সব কিছু বুঝে উঠতে পারিনি, তাদের মন খারাপ করা কান্না আমার মন খারাপ করে দেয়, আমাকে বিষণ্ণ করে । আমি তার মা এবং স্ত্রীকে এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করি ‘একজন খুনির জন্য তারা এত কান্নাকাটি কেন করছে ? আমাকে অবাক করে দিয়ে তাদের দুইজনের একই জবাব- “ সবাই তাকে খুনি বলছে কিন্তু আমরা তো দেখিনা যে সে খুনি ।” মা বলেন , “এতো মা ভক্তি আমি আর কোন সন্তান এর মধ্যে দেখিনি , কোন মানুষের মধ্যে দেখিনি । স্ত্রী বলে, এত ভালবাসা কেউ তার স্ত্রী কে দিতে পারেনা, সব কিছু দিয়ে সে আমার জীবন পরিপূর্ণ করে দিয়েছে-।”
সবকিছু না বুঝলেও এততুকু বুঝতে পারি যে সেই ভয়ংকর খুনি তার মানবিক সত্ত্বা সবটুকুই জাগ্রত রেখেছে শুধু পরিবার এর জন্য, সে এক ভয়ংকর পরিবার প্রেমী স্বার্থপর স্বত্বা। আর তার সবটুকু পাশবিকতা সমাজ, জাতি, দেশের জন্য । সেখানে সে এক পাশবিক স্বত্বার অমানুষ! মনুষ্যত্ব আর পাশবিকতার সমন্বয় এরা জানেনা অথবা করতে পারেনা । হয়েতো একরকম মানসিক বৈকল্যের মধ্যে চলছে এদের জীবন ধারা !বাইরে থেকে এরা স্বাভাবিক কিন্তু আন্তরে এক আসুস্থ , বিকলাঙ্গ স্বত্বা !
মনে পড়ে আর একটি ঘটনার কথা। ২০০৯ সালের কোন এক সময় বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের একজন ধনী নেতা একটি মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে আইনী সহায়তার উদ্দেশ্যে আমার কাছে এসেছিলেন । আমি আমার সাধ্য মত আন্তরিকতা দিয়ে তাঁকে সহায়তা করেছিলাম এবং অবশেষে মামলাকারী অপর পক্ষের আইনসম্মত প্রক্রিয়াগত ত্রুটির জন্য মামলাটি গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে তিনি মামলা থেকে অব্যহতি পেয়েছিলেন এবং কৃতজ্ঞতা চিত্তে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন । তার নিশ্চিন্ত হাসিমুখ দেখে আমিও নিশ্চিন্ত আরাম বোধ করছিলাম । যাবার আগে অতি আপনজনের মত তিনি তাঁর মনের একটি একান্ত আনুভুতির কথা আমার কাছে প্রকাশ করেছিলেন –
তিনি বিষণ্ণ মুখে বলেছিলেন , “ আমার এই বিপদের সময় আমি আমার স্ত্রী , ছেলে , মেয়ে কাউকে একদিন ও চিন্তিত দেখিনি । আমার নির্ঘুম রাতে অবাক হয়ে দেখেছি তাদের নিশ্চিত, সুখী ঘুমন্ত মুখ । দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অভুক্ত আমি এঘর ওঘর আস্থির পায়চারী করে কাটিয়েছি— কানে ভেসে এসেছে গল্প , উচ্চ হাসির শব্দ । বেড়াতে যাওয়া, কেনাকাটা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আনন্দ, ফুর্তি সব চলেছে আগের মতই। নিঃসঙ্গ, একা, দুশ্চিন্তার মধ্যে আমার দিন গুলি কেটেছে, কিছুই তাদেরকে স্পর্শ করেনি, আমার বিপদে আমার পরিবার আমাকে আবাক করেছে, হতাশ করেছে ।”
আমি একমনে তার কথা গুলি শুনছিলাম, তাঁর বিষণ্ণ মুখ আমাকেও বিষণ্ণ করে দিয়েছিলো ! তাঁকে সান্তনা দেবার জন্য একটি ব্যাখ্যা আমার মত করে তাকে আমি বুঝাতে চেয়েছিলাম, আমি বলেছিলাম- “…আপনার কথা গুলি আপনার একান্ত অভিমানের কথা । আপনজন আপনজনের কষ্টে কষ্ট পাবে , ব্যথিত হবে, আন্তরিক সহানুভূতিশীল হবে এটাই স্বাভাবিক, আপনি হয়তো অভিমান থেকে সবাইকে ভুল বুঝেছেন! অথবা ব্যতিক্রম যদি কিছু হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে হয়তো একারণে হয়ছে যে, আপনি আপনার কষ্ট গুলো জানতে দেননি তাদের, নিজেকে অনেক বড় করে ধরেছেন পরিবারের কাছে । আপনি আপনার ব্যাপকতা দিয়ে পরিবারের জন্য একটি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি করে রেখেছেন । তাদের বর্তমানের সাথে মিশে আছেন আপনি আপনার সমস্ত ব্যাপ্তি নিয়ে, তারা নিশ্চিত আছে তাদের নিচ্ছিদ্র নিরাপদ বর্তমান নিয়ে ! তারা সদা আনন্দময়, নিশ্চিন্ত, নির্বিকার…কারো জন্য কষ্ট, দুশ্চিন্তা করার মত কোন ঘাটতি নেই তাদের জীবনে, এরকম কোন ঘাটতি আপনি তাদের জীবনে রাখেননি । তাদের শুধু পরিকল্পনা আপনার দেয়া সুবিধাগুলো কীভাবে উপযুক্ত উপায়ে উপভোগ করা যায়…! আপনি তাদের শক্তিমান বর্তমান, আপনি নিশ্চিন্ত, নিরাপদ ভবিষ্যৎ ! তাই তারা মহাসুখী, সদা আনন্দময়। আপনার কষ্ট পাবার কথা না, অভিমান করার কথা না । তাদের সুখী মুখ দেখে আপনার আনন্দিত হবার কথা খুশি হবার কথা , সুখী হবার কথা…।“ আমার কথাগুলোতে উনি কি বুঝেছিলেন জানিনা তবে উনি আর অপেক্ষা না করে বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ।
এসব কিছুর সাথে মিলিয়ে আমার মনে পড়ছে আনেক পেছনে ফেলে আসা আর একটি ঘটনা –আমার ছোট বেলাতে প্রায়ই শোনা একটি গল্পর কথা মনে পড়ছে। গল্পটি শোনাতেন আমার দাদী যিনি প্রায় সবসময়ে শ্লোক আর গল্প দিয়ে কথা বলতেন । আমার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমানো অভ্যাস ছিল ছোট বেলাতে । দাদী গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন । বিষাদ সিন্ধু, ঈশপ, খনার বচন থেকে শুরু করে ঠাকুর মার ঝুলী, রূপকথা…অনেক অনেক গল্পের মধ্যে দাদী একটি গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকদিন পর পর শোনাতেন। গল্পটি সত্য মিথ্যা জানিনা। তবে দাদী অন্তর দিয়ে গল্পটি শুনাতে পছন্দ করতেন । যতটুকু মনে আছে গল্পটি একজন ডাকাত আর একজন দরবেশ এর –
“নিজাম নামের একজন ভয়ঙ্কর ডাকাত তার বাসা থেকে কিছু দূরে এক জঙ্গলের পাশে লুকিয়ে থাকতো । রাতের আন্ধকারে যে সব সাধারণ মানুষ ওই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যেতো নিজাম ডাকাত তাকে আক্রমন করে তার সবকিছু কেড়ে নিতো । একদিন সেই আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন এক দরবেশ, যিনি নিজে থেকেই নিজাম ডাকাতকে সব কিছু দিয়ে দেন। এরপর তিনি নিজাম ডাকাত কে বলেন , “ তুমি সবকিছু নিয়ে আমাকে এখানে বেঁধে বাড়িতে যাও। বাড়িতে গিয়ে তোমার মা , স্ত্রী , পুত্র , কন্যাদের কাছে জিজ্ঞাসা করো তুমি যে ভাবে সম্পদ অর্জন করছ -এটা অন্যায় এবং পাপ কিনা । যদি পাপ হয়ে থাকে তাহলে এই পাপের ভাগিদার তোমার সাথে তারা ও হবে কিনা , দরবেশ আরও বলেন , তোমার বাড়ি থেকে কি উত্তর পাও তুমি আমাকে এখানে এসে জানাবে এরপর তুমি আমাকে ইচ্ছে করলে মেরে ফেলতে পারো– ।
নিজাম ডাকাত দরবেশের কথা মতো তাকে বেঁধে রেখে বাড়িতে যায় । বাড়িতে গিয়ে দরবেশের শেখানো কথাগুলো বাড়ির সবাইকে একে একে জিজ্ঞাসা করে —- সবার একই জবাব , “ এভাবে সম্পদ অর্জন অবশ্যই অন্যায় এবং পাপ , তবে আমরা এই পাপের বোঝা আমাদের ঘাড়ে নেবো না । আমাদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব তোমার হাতে, তুমি কীভাবে সে দায়িত্ব পালন করবে সেটা তুমি জানো। সেটা পাপ হলে সে বোঝা শুধু তোমার…।”
নিজাম ডাকাত সব বুঝতে পারে , মুহূর্তে বাড়ি থেকে দৌড়ে চলে আসে জংগলের পাশে যেখানে দরবেশকে বেঁধে রেখে গিয়েছে । দরবেশের যা কিছু নিয়েছিল সব ফেরত দিয়ে বাড়িতে সবার সাথে যে কথা হয়েছে আর সবাই যে উত্তর দিয়েছে সব কিছু খুলে বলে…।অবশেষে নিজাম ডাকাত তার সারাজীবনের কৃতকর্মের জন্য আনুতপ্ত হয়ে তখনই সেই দরবেশের কাছে দিক্ষা নিয়ে নিজেও দরবেশের মত পাপমুক্ত নতুন জীবন শুরু করে ।
যে কোন অপরাধী হয়তো শাস্তি পাবে। ঢাকা হয়তো ‘সেভ ’ থাকবে । ঢাকার মানুষেরাও নিরাপদে থাকবে কিন্তু এসব ভয়ংকর মনঃবিকারে আক্তান্ত পরিবার প্রেমী , স্বার্থরপর আপরাধিদের মনের বৈকল্য দুর করতে তেমনই এক দরবেশের সন্ধান আছে কি যার জাদুকরী মন্ত্র এদেরকে সুস্থ, স্বভাবিক, নির্মল, নির্লোভ নিঃস্বার্থ জীবনাদর্শে আনুপ্রানিত করবে ! এদের কে স্বাভাবিক জীবন এ ফিরিয়ে আনবে ! সুন্দর এই পৃথিবীতে সুস্থ ভাবে বাঁচতে শেখাবে !
লেখক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ