আগামী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির। একই সঙ্গে এই সঙ্কটে যে সংবিধানের দোহাই দেয়া হচ্ছে সেই সংবিধান এবং বর্তমান রাষ্ট্র দুটোকেই অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়েছেন তিনি। আর এ সঙ্কট থেকে বাংলাদেশ পরিত্রাণ পাবে কিনা সেটিও শেষ পর্যন্ত হাসিনার ওপরই নির্ভর করবে বলেও মন্তব্য করেছেন নুরুল কবির।
বুধবার রাতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘আরটিভি’র গোলটেবিল বৈঠকে নুরুল কবির এসব কথা বলেন। ‘নির্বাচনকালীন সরকার, প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাব’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকে অন্যদের মধ্যে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আমেনা মহসিন ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মিজানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস।
সংবিধান পুনর্লিখনের যুক্তি দেখিয়ে নুরুল কবির বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান ও রাষ্ট্র দুটোই অগণতান্ত্রিক। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যে সংবিধানে অর্ধশতাধিক প্রভিশনকে বলা হয় কোনো পরিবর্তন করা যাবে না, সেই সংবিধান শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, এই সংবিধান রচনা কিংবা সংশোধনের পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে কোনো ইতিহাসের দর্শনবোধ আছে বলে আমি মনে করি না।
নুরুল কবির বলেন, যেই সংবিধান মানুষের ‘রেফারেন্ডাম’কে নাকচ করে দেয়, অথচ একই সঙ্গে এই সংবিধানকে বলা হয় যে এটি সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা কিংবা অভিপ্রায়ের দলিল, সেই সংবিধান এমনিতেই পুনর্লিখন দরকার, গণতন্ত্রায়ন করা দরকার।বাংলাদেশে কোনো সংসদীয় পদ্ধতি নেই। আগে রাষ্ট্রপতি শাসিত ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী শাসিত। বাংলাদেশের রাজনীতির পরবর্তী ঊষা লগ্নে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে হলে এই সংবিধান এমনিতেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে গণতান্ত্রিকভাবে তা রচনা করতে হবে। তবে এর জন্য রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি।
নুরুল কবির বলেন, আমি এখনও মনে করি, গত নির্বাচনের আগে দেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছিল তার জন্য ‘হাওয়া ভবন’ দায়ী ছিল। আর এবারের সঙ্কটের জন্য দায়ী ‘গণভবন’। এর আগে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য যে আন্দোলন করেছিল, সেই একই রকম আন্দোলন এখনও চলছে। পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত কোনো পরিবর্তন এতদিনেও ঘটেনি।
তিনি বলেন, গণভবনের কর্তা ও রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তা হাসিনার ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করেই আগামী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কারণ, রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়লাভ করার আকাঙ্ক্ষা রাজনীতিবিদদের আগে যেমন ছিল এখনও আছে। এজন্য এখনও পরস্পরের মধ্যে অনাস্থা বিদ্যমান রয়েছে। আর এই অনাস্থা থেকেই সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব ও বিরোধীদলীয় নেতার পাল্টা প্রস্তাবের মন্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান বলেছেন, ‘দুই পক্ষই অনড় থেকে ভোটের আগে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক জয় চায়। তারা ভোটারদের দেখাতে চায়, আমার প্রস্তাবটিকে অন্য দল মানতে বাধ্য হয়েছে।’ড. আকবর আলি খানের এ মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে নুরুল কবির বলেন, উনি (আকবর আলি) মুরুব্বি মানুষ। আমি তার এই মন্তব্যের কোনো সমালোচনা করতে চাই না। কিন্তু আমার উপলব্ধি হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আইনগত কিংবা সাংবিধানিক কোনো বিতর্ক হচ্ছে না। এটি রাজনৈতিক বিতর্ক এবং ক্ষমতার লড়াই।
তিনি বলেন, সংবিধান পরিবর্তনের জন্য ২০১১ সালের এপ্রিলের কমিটিতে যারা ছিলেন, আওয়ামী লীগসহ তারা প্রত্যেকেই আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হওয়া প্রয়োজন বলে লিখেছেন। তাদের মতামত ছিল—বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া দরকার। কারণ, যতক্ষণ না একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে বিকশিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক দরকার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটিকে উল্টে দিয়েছিলেন। আর সে কারণেই আজকে বাংলাদেশে সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
নুরুল কবির বলেন, বর্তমানে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা থেকে বাংলাদেশ পরিত্রাণ পাবে কিনা সেটি শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। কারণ, দুই দল তাদের দাবি থেকে সরে না এলে রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা বিদ্যমান থাকবে। সমঝোতা কীভাবে হবে, আমার ধারণা তা শেষ পর্যন্ত রাজপথে নির্ধারিত হবে।প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলে এসেছেন সংবিধানের বাইরে যাব না’—আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের এমন মন্তব্যের সমালোচনায় নুরুল কবির বলেন, তার (তোফায়েল) কাছে এই ‘সব সময়টা’ কবে থেকে শুরু হয়েছে? কারণ হচ্ছে, যখন আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করেছিল তখন প্রতিপক্ষ বিএনপিও একই কথা বলেছিল।
তিনি বলেন, তারপরও বিএনপি তখন সংবিধানের বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এটা তখনই হয়েছিল যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রাস্তায় মানুষ সংঘবদ্ধ হয়েছিল। এই আওয়ামী লীগও সংবিধানের বাইরে যেতে বাধ্য হবে যদি বিএনপির নেতৃত্বে মানুষ আগের মতোই রাস্তায় নামে। অন্যথায় তারা হেরে যাবে।
নুরুল কবির বলেন, বর্তমান সঙ্কট নিরসনে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্ষমতাসীনদের ইতিহাসবোধ জাগ্রত রাখা। ইতিহাস বলে, পৃথিবীর কোনো সরকার সারা জীবনের জন্য সরকার নয়। ইতিহাস বলে, জনমত উপেক্ষা করে যারা জোর করে ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে চেয়েছে তারা শেষ পর্যন্ত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। আজ তারা যত মন্দ আচরণই করুক না কেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ওই সময়ের অবদানকে চিরদিন মনে রাখবে। কিন্তু এই আওয়ামী লীগ ‘ঘৃণার পাত্রে’ পরিণত হোক, সেটা আমাদের দেখতে ভালো লাগবে না।
নুরুল কবির বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করে জনমত উপেক্ষা করতে থাকলে, ইতিহাস পাঠ থেকে আমি নিশ্চিত, তারা ‘ঘৃণার পাত্রেই’ পরিণত হবে। কারণ, মানুষের আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত সংঘবদ্ধ পেশিশক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হয়।