৫ বছরের শিশু সামিয়া। চাঁদপুর সদর উপজেলার পশ্চিমসকাদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয় তাকে। প্রথম দুই দিন মা তাকে নিয়ে ক্লাসে বসেছিল, তৃতীয় দিন মা ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করছিল। মাকে না দেখে সামিয়া ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে মাকে খুঁজতে থাকে। ক্লাসে তার মন নেই, তার চোখ মায়ের দিকে। ক্লাসের সমবয়সী কারো সঙ্গেই তার সখ্য গড়ে ওঠেনি। স্কুলের পরিবেশের সঙ্গে মিশতে পারছে না সে। এভাবে কিছু দিন অতিবাহিত হবার পর তার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন মাতুয়াইল এলাকার নাজমুল হাসানের পাঁচ বছরের ছেলে হাসিব হাসানকে ভর্তি করানো হয় মাতুয়াইল পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে। প্রথম দিন বাবা স্কুলে নিয়ে এসে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে চলে এলে হাসিব চিত্কার করে বাবার সঙ্গে চলে আসে। পরদিন মাকে সঙ্গে করে ক্লাসে বসে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্লাসের ভেতর অভিভাবকদের বসতে নিষেধ করে। মা বাইরে চলে এলে সেও চিত্কার করে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। এভাবে কিছুদিন পর তারও স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
এমন অনেক কেস স্টাডি করে আমরা জানতে পারলাম, শিশুকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা না দিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠালে শিশু বিদ্যালয়মুখী হয় না। স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা না দিয়ে স্কুলে পাঠালে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলেন, শিশুকে বিদ্যালয় পাঠানোর উপযোগী না করে স্কুলে পাঠালে শিশুর শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এজন্য সরকার ২০১০ সাল থেকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। ২০১১ সাল থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চলমান আছে। পর্যায়ক্রমে সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ শিক্ষা চলছে। দেশের ৬২ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পরিচালনাধীন মসজিদ ও মন্দিরভিত্তিক বিদ্যালয় যাওয়ার উপযোগী শিশু শিক্ষার ফলে ২০১৩ সালে প্রায় ৩০ লাখ শিশুকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা হয়েছে এবং ২০১৪ সালের ৩৬-৪০ লাখ শিশুকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষা অধিদপ্তর কাজ করছে।
জাতীয় জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। দেশের অধিকাংশ শিশুরই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক ও দৈহিক যোগ্যতা অর্জনের পরিবেশ সীমিত। এদের জন্য বিদ্যালয়-প্রস্তুতিমূলক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা আবশ্যক। সমবয়সী শিশুদের একত্রে এই প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা শিশুর মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। এই পর্যায়ে শিক্ষাক্রম হবে মূলত শিক্ষার প্রতি, বিদ্যালয়ের প্রতি শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি করা। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি হবে ৪+ বছর বয়স্ক শিশুদের জন্য।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রতি বিদ্যালয়ে একটি করে বাড়তি শিক্ষকের পদ সৃষ্টি ও একটি করে শ্রেণিকক্ষ বৃদ্ধি করা ব্যয়বহুল কাজ। এসব কিছু বিচার করে একই সঙ্গে সকল বিদ্যালয়ে এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শুরু না করে, ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়। এই মুহূর্তে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রথম শ্রেণিতে সাড়ে চার বছর বয়সে ভর্তি করে প্রথম ছয় মাস প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা হিসেবে চালু করা যেতে পারে। পাশাপাশি এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য বিদ্যালয়গুলোর প্রস্তুতি চালানো হবে যাতে আগামী ৫ বছরের মধ্যে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪+ বছর বয়স্ক শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা যায়। এর বাস্থবায়নে স্থানীয় সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং এর ব্যয়ভার বহনে ও ব্যবস্থাপনার জন্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
• প্রতিটি শিশুর জীবনে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অত্যধিক। দেশের সব মানুষের শিক্ষার আয়োজন এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার অনন্য ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা। দেশের উন্নতির লক্ষ্যে সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অপরিহার্য। প্রাথমিক শিক্ষার মান যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার এই স্তর পরবর্তী সব স্তরের ভিত্তি সৃষ্টি করে বিধায় যথাযথ মানসম্পন্ন উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। প্রাথমিক শিক্ষা হবে সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের এ জন্য শিশুর জীবনের শুরুতে টেকসই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন—
• শিশুর যথাযথ মানসম্পন্ন ব্যবহারিক সাক্ষরতা নিশ্চিত করে উচ্চতর ধাপের শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী ও আগ্রহী করে তোলা।
• শিশুকে জীবনযাপনের আবশ্যকীয় জ্ঞান, দক্ষতা, নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতা অর্জনের মাধ্যমে মৌলিক শিখন চাহিদা পূরণে সমর্থ করা এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষালাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
• মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে শিশুর দেশাত্মবোধের বিকাশ ও দেশগঠনমূলক কাজে তাকে উদ্বুদ্ধ করা।
• সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ এবং অর্থপূর্ণ শ্রমের প্রতি আকৃষ্ট করার মাধ্যমে শিশুকে তার জীবন সমস্যা সমাধানের যোগ্য করে তোলা।
• শিশুর মনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচারবোধ, মানবাধিকার, সহ-জীবনযাপনের মানসিকতা, কৌতূহল, প্রীতি, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করা এবং তাকে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক করা।
• দেশে প্রাথমিক স্তরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার বিষয়সমূহ হবে মাতৃভাষা, গণিত, পরিবেশ পরিচিতি-সমাজ ও বিজ্ঞান। এছাড়া থাকবে চারু ও কারুকলা, শারীরিক শিক্ষা, সংগীত ইত্যাদি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ইংরেজি অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে পড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে তা বাধ্যতামূলক হবে। তৃতীয় শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলক ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। প্রথম শ্রেণি থেকে সহপাঠ্যক্রমিক বিষয় থাকতে পারে। প্রাথমিক স্তরের শেষ তিন শ্রেণিতে অর্থাত্ ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জীবন পরিবেশের উপযোগী কিছু বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান করা হবে, যাতে যারা আর বিদ্যালয়ে পড়বে না এ শিক্ষার ফলে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে।
শ্যামল কান্তি ঘোষ আরও বলেন, দেশের ৪-৫ বছর বয়সী সব শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করার জন্য সরকার নতুন শ্রেণি তৈরি করে ৩৭,৬৭২ জন নতুন শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রতিবছর প্রায় ৩৮ লাখ শিক্ষার্থী ১ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পরিচালনাধীন মসজিদ, মন্দিরভিত্তিক শিশু শিক্ষা কার্যক্রম ও বেসরকারি এনজিওর পরিচালনাধীন শিশু শিক্ষা কার্যক্রমের ফলে দেশের তৃণমূল পর্যায়ও শিশুরা বিদ্যালয় যাওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে এবং শিশুর শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়ার হার হ্রাস পায়।
চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আকতার হোসেন জানান, শিক্ষা জীবনের মজবুত ভিত তৈরিতে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষ ভূমিকা রাখে। দেশের পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের স্কুলমুখী করার জন্য সরকারের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প সুফল পেতে শুরু করেছে। দেশের ৬২ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দিরভিত্তিক শিশু শিক্ষার ফলে প্রায় ৩০ লাখ শিশু শিক্ষার্থী প্রতিবছর বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে। প্রাক প্রাথমিক শিক্ষায় পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের খেলার ছলে ও আদর করে, বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে ও ছবি দেখিয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। এতে করে শিশুর বিদ্যালয় ভীতি দূর হয়। স্কুলের প্রতি আগ্রহ বাড়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হয়। শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়ার হার কমে।
চাঁদপুর পুরানবাজার ২নং বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল বাতেন মিজি বলেন, প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর শিক্ষা জীবনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এতে শিশুর স্কুল ও শিক্ষক ভীতি দূর হয়। স্কুলের প্রতি আগ্রহ বাড়ে বই পড়ায় মনোযোগী হয়। সমবয়সী বন্ধু পেয়ে ও খেলার সাথী পেয়ে স্কুলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়া হ্রাস পায়।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুফল হলো—শিশুর স্কুলের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়, শিশুর শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়ার হার কমে, বিদ্যালয়ের পরিবেশের প্রতি ধারণা লাভ করে, সমবয়সী অনেক বন্ধু-বান্ধব জোটে, বিদ্যালয় ভীতি হ্রাস পায়, পরীক্ষা ভীতি হ্রাস পায়, স্কুলশিক্ষক সম্পর্কে ধারণা অর্জন হয়, শিশুর শিক্ষাজীবনের ভিত তৈরি হয় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায়।
দেশের সাংবিধানিক তাগিদে বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে সমগ্র দেশে প্রাথমিক স্তরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা প্রয়োজন। অর্থাত্ প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন ধারার সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয় শিক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে যে বৈষম্য বিরাজমান, তার অবসান ঘটিয়ে সবার জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে একই মান ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা।
শিরোনাম:
মঙ্গলবার , ১৭ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ৩ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।