রুদ্র মিজান
উপস্থাপক ফারুকী হত্যাকাণ্ডের পর ১৭ দিন পার হলেও রহস্যের কোন কিনারা হয়নি। হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে না পারায় আতঙ্কে ভুগছেন পরিবারের সদস্যরা। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তারা বাসার বাইরে বের হচ্ছেন না। হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ পর্যন্ত থেমে যেতে পারে, এটি ধামচাপা দেয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। এদিকে, আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে
দেশব্যাপী তিন দিনের কর্মসূচি শুরু করেছে ইসলামী ফ্রন্টের সহযোগী সংগঠন ছাত্রসেনা। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে টেলিভিশনের ৬ উপস্থাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের পরও কাউকে আটক করা হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফারুকীর পরিবারের সদস্যরা। আদালতে এই অভিযোগ করেছেন ছাত্রসেনার ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার। তিনি জানান, আসামিদের এ পর্যন্ত গেপ্তার না করায় আমরা হতাশ হয়েছি। তাদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বুধ বার সারা দেশে মানববন্ধন ও রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। এভাবে আজ বৃহস্পতি ও শুক্রবার কর্মসূচি পালন করা হবে। এই কর্মসূচির শেষ দিন শুক্রবারে জুম্মার পর বায়তুল মোকাররমের উত্তরগেটে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে স্বরামন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি। ইমরান হোসেন তুষার বলেন, আন্দোলন ছাড়া ফারুকী হত্যার বিচার হবে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা সন্তোষজনক নয়।
তুষারের দায়েরকৃত অভিযোগ সম্পর্কে ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী বলেন, টেলিভিশনের অভিযুক্ত এই উপস্থাপকরা হত্যাকান্ডে জড়িত থাকতে পারে। তিনি জানান, খুন করার আগে যারা একাধিকবার তার বাবাকে হুমকি দিয়েছে তারা এই চক্রের হতে পারে। হুমকির বিষয়ে ঝামেলা এড়াতে থানায় কোন সাধারণ ডায়রি করেননি ফারুকী। তবে হুমকি বিষয়ে প্রকাশ্য ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। ফয়সাল জানান, সর্বশেষ ২৫শে আগস্ট ঢাকার টঙ্গীতে একটি ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দিয়েছিলেন ফারুকী। রাত ১১ টার পরে ওই মাহফিলে প্রায় দুই ঘণ্টার বক্তব্যে ফারুকী তার জীবন নাশের আশঙ্কা ব্যক্ত করে জানান, তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। অভিযোগ দায়েরের পর টঙ্গীর ওয়াজ মাহফিলে ফারুকীর বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ তদন্তকারী কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর জুলহাস আহমেদের কাছে দেয়া হয়েছে। এরপরও এখন পর্যন্ত খুনীদের চিহ্নিত করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, এই মামলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি নেই। অপরাধীদের সনাক্ত করতে তদন্ত অব্যাহত আছে। গতকাল দুপুরে ফারুকীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, বাসাটি সুনসান নীরব। প্রধান ফটকের পাশে দেয়ালে ফারুকীর খুনিদের ফাঁসির দাবি সংবলিত একটি ব্যানার। বাসার গেইটের ভেতরে সিঁড়ির নিচে প্রহরায় আছেন দু’জন পুলিশ সদস্য। পরিচয় দিয়ে নিহত ফারুকীর দু’তলার ভাড়া বাসায় ঢুকে কথা হয় তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। ফারুকীর লাশ দাফনের পর আর বাইরে বের হননি তার স্ত্রী লুবনা ফারুকী। আগের মতো প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলেন না তিনি। নামাজ পড়ে ফারুকীর জন্য দোয়া করেন। আশায় আছেন তার হত্যাকারীরা গ্রেপ্তার হবে। লুবনা ফারুকীর বিশ্বাস একজন ধর্মপ্রাণ মানুষকে হত্যা করে খুনিরা রক্ষা পাবে না। ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করার পর খুনীরা লুবনাকে বলেছিল, তোদের কাউকে বাঁচতে দেবো না। তাই সন্তানদের নিয়ে এখন আতঙ্কে আছেন লুবনা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র ফয়সাল ফারুকী তার পিতার মৃত্যুর পর ক্যাম্পাসে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ফয়সাল জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বারিধারা। তার পিতার মৃত্যুর পর বাসা থেকে বের হতে ভয় করে। আতঙ্কে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে যান না তাদের পরিবারের কেউ। ব্যবসা সংক্রান্ত জরুরি কাজে বাসার বাইরে যেতে হয় ফারুকীর ছেলে আহমাদ রেজা ফারুকীকে। ফারুকীর ছোট ছেলে মুহাম্মদপুরের কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদরাসার দাখিল পরীক্ষার্থী ফুয়াদ ফারুকী জানান, দুর্বৃত্তরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আতঙ্ক কাটবে না। তার বাবার মৃত্যুর পর থেকে তিনি মাদরাসামুখি হননি। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ ৩৯৬ ধারায় ডাকাতিসহ খুন হিসেবে রেকর্ড করে পুলিশ এই মামলাকে হালকা করেছে। এ বিষয়ে ফয়সাল ফারুকী জানান, হত্যাকান্ডের কয়েক ঘণ্টা পর রাত ৩টায় পুলিশ একটি মাইক্রোবাসে করে মামাতো ভাই মারুফ, মামা গোলাম রব্বানী ও আহমাদ রেজা ফারুকীর বন্ধু জুয়েলসহ তাকে শেরেবাংলা নগর থানায় নিয়ে যায়। সেখানে তাদের বক্তব্য নিয়ে তা একটি কাগজে কম্পোজ করে পড়ে শুনিয়ে এতে স্বাক্ষর করতে বলেন থানার সেকেন্ড অফিসার মুহাম্মদ আবু জাফর। লিখিত সাক্ষ্য মনে করেই এতে স্বাক্ষর করেন ফায়সাল ফারুকী। ফয়সাল বলেন, তখনও আমি জানতাম না যে এটি মামলা হচ্ছে। ২৯শে আগস্ট সাংবাদিকদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন তাকে বাদী করে ডাকাতিসহ খুনের মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, বাবার মৃত্যুর পরপর বোঝার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। বড় ভাই মাসুদ বিন নূর ও আহমাদ রেজা ফারুকী ছিলেন দেশের বাইরে। এ অবস্থায় পুলিশ আমাকে না বুঝিয়েই মামলা রেকর্ড করে নিয়েছে। এই অভিযোগ অস্বীকার করে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মুন্সী সাব্বির আহমেদ বলেন, শিক্ষিত ছেলে হিসেবে তার কাছে এ ধরনের বক্তব্য আশা করি না। তবে ফয়সাল দাবি করেন, মামলাতে যেন দন্ডবিধির ৩০২ ও ৩৪ ধারা সংযুক্ত করা হয়। কারণ এটি মূলত ডাকাতি না বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বাসা থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নেয়া হয়েছে হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য। সেই সঙ্গে টেলিভিশনের ৬ উপস্থাপকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করার দাবি জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২৭শে আগস্ট রাত পৌণে ৮টায় দুর্বৃত্তরা ফারুকীর পূর্বরাজাবাজারের বাসায় ঢুকে অস্ত্র দেখিয়ে পরিবারের সবাইকে জিম্মি করে বেঁধে রাখে। পরে ফারুকীকে তারা গলা কেটে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
শিরোনাম:
শুক্রবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ২৫ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।