অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম আরো দক্ষভাবে সম্পন্ন করতে দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আপারেটরদের যুক্ত করতেই আগ্রহ বেশি। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রথম সারির ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলেও অনেকে আবার নিরাপত্তা ইস্যুকে সামনে এনেছেন।
বিশ্বব্যাংকের বন্দরসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য দায়ী করা হয়েছে শতভাগ সরকারি ব্যবস্থাপনাকে। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো বন্দর এভাবে চলে না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বন্দর, যেটি ‘টুল পোর্ট’ পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ বন্দর পরিচালনার সব গুরুদায়িত্ব সরকারের হাতে। বিশ্বের সব উন্নত বন্দর যদিও পরিচালিত হয় ‘ল্যান্ডলর্ড’ মডেলে, যার বেশির ভাগ কাজ চলে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। সরকার শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশেও এ মডেলে বন্দর চললে খরচ কমবে ৯ শতাংশ। একই সঙ্গে বন্দর ব্যবস্থাপনায় ৭ শতাংশ গতি বাড়বে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশী অপারেটর নিয়োগ হলে এতে দক্ষতা বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এটাও ঠিক যে এখন বন্দর ব্যবস্থাপনায় যে দুর্নীতি আছে সেটা অনেকটাই দূর হয়ে যাবে। আবার উল্টো পিঠে বন্দর অপারেশনের যে মুনাফা সেটা বিদেশীদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। এজন্য পুরোপুরি বেসরকারি খাতে ছেড়ে না দিয়ে একটি যৌক্তিক কাঠামো ঠিক করতে হবে।’
বিশ্বব্যাংকের নতুন আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে যে তিনটি পরামর্শ দেয়া হয়েছে তার প্রথমটিই হলো ‘ল্যান্ডলর্ড পোর্ট’ মডেল। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবে অত্যাধুনিক বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এ মডেল বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলছেন বন্দর ব্যবহারকারী দেশের প্রথম সারির ব্যবসায়ীরাও।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দেয়ার তালিকায় রয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), মাতারবাড়ী বন্দর ও বে-টার্মিনাল। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিসহ নিউমুরিং ওভারফ্লো কনটেইনার ইয়ার্ড পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক মানের বেসরকারি অপারেটর নিয়োগে প্রকল্প প্রস্তাব সর্বশেষ অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগতভাবে অনুমোদ পেয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে। নিয়ম মেনে প্রস্তাবটি এখন পিপিপিতে যাবে। এ বিষয়ে একটি বিজনেস ও ফাইন্যান্সিয়াল মডেল দাঁড় করাতে এবং আরএফপি (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) তৈরির জন্য নিয়োগ করা হবে আন্তর্জাতিক ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার। তাদের দেয়া প্রপোজালের ভিত্তিতেই আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনায় বসবে সরকার।
এনসিটি পরিচালনার বিষয়ে অবশ্য বহু আগে থেকেই দুবাইভিত্তিক বন্দর পরিচালনাকারী কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছে। ২০০৭ সালে ৫৬৬ কোটি টাকা খরচ করে এ টার্মিনাল নির্মাণের পর অপারেটর নিয়োগের জটিলতায় আট বছর বন্দর কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি চালু করতে পারেনি। নির্মাণের পর এর দুটি জেটিতে দেশীয় বেসরকারি সংস্থা সাইফ পাওয়ারটেককে সরাসরি নিয়োগ দিয়ে অ্যাডহক ভিত্তিতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করা হয়। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি টেন্ডারের মাধ্যমে এনসিটির চারটি জেটি পরিচালনার দায়িত্ব পায় সাইফ পাওয়ারটেক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকার এখন পিপিপির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপারেটর নিয়োগ দিয়ে টার্মিনালটি পরিচালনা করতে চায়। এনসিটিতে আন্তর্জাতিক অপারেটর নিয়োগে বন্দরের প্রকল্প প্রস্তাবটিও এরই মধ্যে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে।
দেশে ইস্পাত খাতের কাঁচামাল আমদানির শীর্ষে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে বন্দর ব্যবহারকারী হিসেবেও এগিয়ে রয়েছে বিএসআরএম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আলী হোসাইন আকবর আলী এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আধুনিক বন্দর ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠলে আমদানি-রফতানিতে যুক্ত ব্যবসায়ীরা সময় ও আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। স্বাভাবিকভাবেই এর সুফল যোগ হবে দেশের অর্থনীতিতে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর এখন যেভাবে চলছে এখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। যখন এটা তৈরি হবে তা দেশের অর্থনীতির জন্যই ভালো হবে। বিদেশী অপারেটর যাদের বন্দর ব্যবস্থাপনায় সুনাম আছে তারা এখানে বিনিয়োগ করবে, ঝুঁকি নেবে এবং সেবা নিশ্চিত করবে। শতভাগ সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকলে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে করা হয়ে ওঠে না। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বন্দরের সময়ক্ষেপণে উদ্যোক্তাদের আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতির শিকার হতে হয়। এছাড়া কাজের পরিসর বেড়ে চট্টগ্রাম বন্দরও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে আন্তর্জাতিক অপারেটরদের এ পরিচালনার দায়িত্ব কোন পদ্ধতিতে দেয়া হচ্ছে। বিওটি (বিল্ড, অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার) হিসেবে যদি দেয় এটা বেশ ভালো হবে। ওরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টার্মিনাল পরিচালনা করবে। উদাহরণ হিসেবে ২০ বছরের জন্য যদি দেয়া হয়, তারা এ সময়ে আয় করে চলে যাবে। তখন মালিকপক্ষ চলে গেলেও অসুবিধা হবে না। কেননা এ পদ্ধতিতে সরকারও অংশীদার থাকছে। এক্ষেত্রে সরকারকে দক্ষভাবে দরকষাকষির মাধ্যমে রেটটা যৌক্তিক জায়গায় ঠিক করে নিতে হবে। দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় এর চেয়ে ভালো কোনো পদ্ধতি হতে পারে বলে আমার মনে হয় না।’
বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার অপেক্ষায় সদ্য শেষ হওয়া আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে এর জেটি ইয়ার্ডসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামোর পুরোটাই নিজস্ব অর্থায়নে করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এখন অপারেটর নিয়োগ হলে টার্মিনালের প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করে পরিচালনায় যুক্ত হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, নিয়োগ হওয়া অপারেটর বন্দরের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। মেয়াদ শেষে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে দেবে। পিসিটি পরিচালনার কাজ পেতে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি), দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড ও ডেনমার্কের কনটেইনার পরিবহন কোম্পানি এপি মুলার জোর লবিং চালালেও কাজ পাওয়ার ব্যাপারে এগিয়ে রয়েছে আরএসজিটি। এ নিয়ে কোম্পানিটির সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেছে মন্ত্রণালয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে লেনদেন উপদেষ্টা হিসেবে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি) নিয়োগ দিয়েছে। বিষয়টি চূড়ান্ত হলে এটিই হবে বিদেশী সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত প্রথম কোনো বাংলাদেশী টার্মিনাল।
দেশের আরেক ভারী শিল্প সিমেন্ট খাতের নেতৃত্বে থাকা প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রকল্প এলাকার অদূরে কেপিআইসহ রাষ্ট্রীয় আরো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থাকায় নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। আমাদের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিযোগিতাকে সীমিত করে রাখা যাবে না। পিসিটির জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশী অপারেটর দেয়ার, যেটা পাঁচ বছরের জন্য হতে পারে। সমুদ্রবন্দরকে আরো বেশি কার্যকর করে গড়ে তোলা গেলে ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাবেন। অর্থনীতি এভাবেই এগোবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত প্রকল্প বে-টার্মিনাল। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এ প্রকল্পের তিনটি অংশ হবে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে একটি অংশ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়ার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে সরকার। আরেকটি অংশ পরিচালনার ব্যাপারে লবিংয়ে এগিয়ে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি পিএসএ। তবে বাকি আরেকটি অংশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়া মাতারবাড়ীতে এরই মধ্যে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখন দরপত্রের মূল্যায়ন চলছে। জাইকার অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ায় মূল্যায়নটা তারাই করছে। মাতারবাড়ী বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও জাপানের কোনো প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে বলে আলোচনা আছে।
তৈরি পোশাক রফতানির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরকে বড় পরিসরে ব্যবহার করে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সহসভাপতি সৈয়দ এম তানভির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা যারা বন্দর ব্যবহার করে রফতানিতে যুক্ত তাদের লিড টাইম ঠিক রাখতে হয়। যদিও আমাদের দেশে এটা একটা চ্যালেঞ্জ। বাণিজ্য প্রসারে লজিস্টিকস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ দেশের অন্যান্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কয়েক গুণ বাড়বে। তাই এখনই বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে এ কাজে দক্ষ ও প্রতিষ্ঠিত অপারেটর এলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। দক্ষতা বাড়বে। এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে যদি কেউ ভালো দক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারে তাদের প্রস্তাবও বিবেচনায় থাকতে পারে। পদ্ধতিটি এমন হতে পারে, বন্দর ব্যবস্থাপনা শতভাগ বেসরকারি খাতে যেমন ছেড়ে দেয়া যাবে না আবার পুরো পরিচালন কার্যক্রম সরকারিভাবে রেখেও সময়ের সঙ্গে পিছিয়ে পড়া চলবে না।’
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখানে ছুটে আসছেন। দেশে বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগে দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুরের পিএসএ, দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ডসহ আরো অনেক দেশের বেশকিছু প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে বে-টার্মিনালে পরামর্শক নিয়োগ করে এর প্রতিবেদনও আমরা পেয়েছি। এটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল হবে, যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও একটি অংশ পরিচালনা করবে। তিন বছরের মধ্যেই টার্মিনালটি ব্যবহারের উপযোগী হবে বলে আশা করছি। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারা এখানে অর্থায়নে আগ্রহী। অনেক দেশেরও বিনিয়োগ প্রস্তাব আছে আমাদের কাছে। মাতারবাড়ীতে পরামর্শক এরই মধ্যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দরপত্র মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে ঠিকাদার নিয়োগ দিতে পারব। সব প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই বিদেশী বিনিয়োগ আনা হবে।’