আল-আমিন মজুমদার:
সর্বনাশী সর্বগ্রাশি নেশা ! যা হল ড্রাগ বা মাদক দ্রব্যের নেশা। এ নেশা এমনই নেশা যে, তা ব্যক্তিকে শুধু তার পরিবার, সমাজ, দেশ থেকেই বিচ্ছিন্ন করেনা তার জীবনকেও বিপন্ন করে তোলে। মাদকের নেশা এখন আলো ঝলমল নগরীর প্রাণ কেন্দ্র থেকে শুরু করে অন্ধকার গ্রামেও এর অবাধ বিচরন।
মাদকাসক্তি! যাকে বলা হয় সকল সন্ত্রাস ও অপরাধের জনক। এক জন মানুষ যখন অন্ধকারের ভূবনে পা বাড়ায় তখন সে প্রথম সিড়ির যে ধাপটিতে পা রাখে তা মাদকদ্রব্য। এই মাদকদ্রব্য তাকে টেনে নেয়, উৎসাহিত করে পরবর্তি ধাপ গুলো পেরিয়ে যেতে। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাদক ব্যবসা ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান প্রেক্ষিতে তরুন সমাজ এদিকে ঝুকছেও বেশি – ঠিক যেমনটি প্রত্যাশা মাদক ব্যবসায়ীদের।
সর্বনাশা মাদকের কারণে যুব সমাজ যে শুধু মেধা শূন্য হচ্ছে তাই নয় এই মাদকাসক্তদের মধ্যে মনুষত্ব লোপ পাচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের দেশের সংবাদপত্রে প্রতিদিন যে সব খুন সন্ত্রাস মেয়েদের উত্তপ্ত করার ঘটনা সহ সকল অপরাধের খবর ছাপা হচ্ছে তা সকল ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দেশের তরুন যুব সমাজ এর একটি অংশ। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্বক যে বিষয়টি জাতির জন্য উদ্বেগের এবং আমাদেরকে সতর্ক হতে নির্দেশ দিচ্ছে তা হল এদেশের অধিকাংশ আজ মাদকাসক্ত নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই দেশের যুব সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তির পরিমাপ সাম্প্রতিক সময়ে আশংকাজনক ভাবে বেড়ে গেছে।
প্রায় সকল মাদকাসক্ত লোক একটি মাদক দ্রব্যের প্রতি খুব উত্তপোল যা হলো গাঁজা। সহজলভ্য ও স্বল্পমুল্যে পাওয়া যায় সর্বনাশা গাঁজা যা সচরাচর বেশি সেবন করতে দেখা যায় স্বল্প আয়ের নিম্ন শ্রেণীর মাদকসেবীদের। বাংলাদেশের শহর জনপদের ধনী পরিবারের সন্ত্মানদের মধ্যে সম্প্রতি ইয়াবা আসক্তির যে প্রবনতা দেখা দিয়েছে তা সমগ্র জাতির জন্য এক ভয়াবহ পরিনতির ইঙ্গিতবাহি। ইয়াবা কেবল আমাদের তরুন প্রাণশক্তি ও মেধাকে ধ্বংস করছে না ইয়াবার কারণে সমাজে রন্দ্ব্রে রন্দ্ব্রে অপসংকৃতির ও অপরাধের বিস্ত্মার ঘটছে। ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত্ম সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাদকাশক্তদের মধ্যে হেরোইন সেবনের মাত্রা বেশি সাদা পাউডার জাতীয় এই নেশা সেবনের হার মারাত্বক হারে বেড়েই চলেছে। মোট মাদকাসক্তের ৭৫ ভাগ ছিল হিরোইন সেবী। ১৯৯৬ সালে এই হার ছিল ৫১ শতাংশ। ১৯৯৮ সালে ৬২ শতাংশ এবং ২০০০ সালে দাড়ায় ৭২ শতাংশ। দেশের প্রায় অর্ধশতাধিক রুট দিয়ে স্থল ও নৌ পথে এদেশে মাদক প্রবেশ করে। বিমান ও জাহাযে করে পৌছে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বাজার বা গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। লক্ষ্যনীয় বাংলাদেশে মাদকের যোগান ও ব্যবহার কত দ্রুত বর্ধনশীল। আরো লক্ষ্যনীয় বহুল মাদক দ্রব্যের সর্বত্র অবাধ বিচরন যেমন ভায়াগ্রা, ইয়াবা, ফেন্সিডিল, ক্যানবিয়ার, কোকেন ও নানা ধরনের নেশার ইনজেকশন। যা দেশের অভ্যন্ত্মরে বহন করছে মোটরসাইকেলের সিটের নিচে, মৌসুমি ফলের খাচায় লুকিয়ে, মিষ্টি, শাড়ীর প্যাকেট, গিফট বঙ্, দুধের কলস। সিএনজি চালিত অটোরিঙ্া ছোট যানবাহনের ইঞ্জিনের নিচে ট্রাকের পাটাতন, টুলবঙ্, ট্রাক ও বাস চালকের সিটের নিচে বঙ্ েকরে। পুরুষ ও মহিলাদের কাপরের নিচে শরীরের বাঁধা (চোরাচালানিদের ভাষায় বডি পিটিং) অবস্থায়।
বাংলাদেশের মাদকাসক্তরা তাদের আসক্তির পেছনে বছরে খরচ করে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা। এক জরিপে দেখা গেছে বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা কম পক্ষে ৫০ লাখ। কোন কোন সংস্থার মতে ৭০ লাখ। নব্বইয়ের দশকে যার পরিমান রেকর্ড করা হয় ১০ লাখের ও কম। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক জন মাদকাসক্ত তার নেশার পেছনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে সর্ব নিম্ন ৫০ টাকা খরচ করে তবে বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই দৈনিক খরচ ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। আর পক্ষান্ত্মরে এই নেশার টাকার যোগান দিতে আসক্তরা বেছে নেয় বিভিন্ন অন্যায় পথ। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে খুন, ছিন্ত্মাই, ডাকাতির মত ঘটনা নেশার জন্য বাবা খুন হচ্ছে সন্ত্মানের হাতে, স্ত্রী খুন হচ্ছে স্বামীর হাতে, ভাই খুন হচ্ছে ভাইয়ের হাতে। মাদকাসক্তের ৫৯ শতাংশই আসে এমন পরিবার থেকে যাদের মাসিক আয় ১০০০ থেকে ৫০০০ টাকার মধ্যে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাদকাসক্তদের ৩০ শতাংশই শুধু নেশার খরচ যোগান দিতেই নানা অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়ে। এই সব জরিপে যে তথ্যটি সবচেয়ে বেশি আতংক ও ভয়ের কারণ, তা হচ্ছে দেশে মাদকাসক্তের ৯১ শতাংশই কিশোর, তরুন ও যুবক বয়সি। আর এই আসক্তির ভয়াবহ বিস্ত্মার ঘটেছে ছাত্র এবং শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে। আমাদের দেশে মহিলাদের মধ্যেও মাদকা সক্তের সংখ্যা বাড়ছে। এটা উদ্বেগের কারণ। নারী আসক্তদের ৯০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। বাদ বাকী ৩৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৫ জন নারী। তাদের মধ্যে ছাত্রী, গৃহিনী, ব্যবসায়ী, চাকুরী জীবি রয়েছেন।
মাদক কি আমাদের সমাজে তাহলে সকল পরিবারেই ঢুকে পড়েছে? নাকী আমরা আমাদের সন্ত্মানদের সঠিক ভাবে পরিচালিত করতে পারছিনা? এই দায় ভার কারা নেবে? পরিবার, সমাজ না দেশ? বিশেষজ্ঞদের মতে মাদকাসক্তদের শুধু দায়ী করলেই হবে না এর সাথে একদিকে দারিদ্র ও বেকারত্বজনিত বিপুল হতাশা, অন্যদিকে সকল পর্যায়ে নীতি -নৈতিকতা বির্বজিত সীমাহীন লোভ গোটা সমাজকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। মাদক পাচার ও ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্ত্মি দেওয়া সহ মাদক পাচার রোধ ও মাদকের সহজ প্রাপ্যতা বন্ধ করত হবে। এছাড়াও প্রত্যেক অবিভাবকের মাঝে মাদক সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নিজ সন্ত্মানের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। দেশের সরকার ও জনগনের সমন্বয় প্রচেষ্টায় এই ভয়াবহ ব্যাধি দূর করতে হবে। সম্প্রতি এই সব মাদকাসক্তদের দ্বারা খুন রাহাজানি বন্ধ করতে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দোষিদের দৃষ্টান্ত্মমূলক শাস্ত্মি নিশ্চিত করা জরুরী। পাশাপাশি আমাদের সমাজে তরুন যুবসমাজকে মাদকাসক্ত ও বখাটে হবার আগেই সচেতন করার জন্য সকল মাধ্যমকে জরুরী ভিত্তিতে কার্যকর করা জরুরী। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয়, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে উৎসাহিত করতে হবে। মাদকাসক্তি নিরসনে ব্যাক্তির নিজ ও তার পরিবারের নিজ ও তার সার্বিক সহযোগীতাসহ সেবা প্রদানকারী সবার সচেতনতার কোনো বিকল্প নাই, আমাদের এই সচেতনতা এবং সহযোগীতা যুবসমাজকে যুবশক্তিতে পরিণত করবে। এই ব্যধি দূর করতে আপনি সচেতন মানুষ হিসেবে যা করবেন ? মাদকাসক্ত ব্যক্তি একজন রোগী, তাকে মাদক মুক্ত সুন্দর জীবনের প্রেরনা দিন।মানসিক ডাক্তারের পরামর্শ নিন। নিকটস্থ সরকারি মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্রে যোগাযোগ করুন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিকটস্থ কার্যালয়ে যোগাযোগ করুন। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই সম্ভব মাদকের প্রতিরোধ প্রতিকার।
চাঁদপুর নিউজ সংবাদ