শিপন হাবীব
আট ফুট বাই ১০ ফুটের এক চিলতে ঘর। সূর্যের আলো ঢোকে না। এক ফালি জানালা। বাইরের বাতাস ঘরে প্রবেশ করে না। প্রবল দমকা হাওয়া সহজেই ঝুপড়ি ঘরটির চালসহ পলিথিন আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গড়া বেড়া দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে। বৃষ্টির ঝাপটা নড়বড়ে চালটা ভেদ করে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এই ঝুপড়ি ঘরেই বাস করেন ভারতের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী বাংলাদেশের স্বর্ণকন্যা মাবিয়া আক্তার সিমান্ত। মাবিয়া বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকায় পৌঁছেন। ওই রাতে রাষ্ট্রের কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা মাবিয়াকে রিসিভ করেননি। ভোররাতে মামার একটি ভাঙাচোরা মোটরসাইকেলে চড়ে পৌঁছেন রাজধানীর খিলগাঁও সিপাহীবাগ বাজার সংলগ্ন ঝিলে। যে ঝিলের ওপর তাদের ঝুপড়ি দুটি ঘর। নিচে মলমূত্র আর কালো দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি থইথই করছে। মাবিয়ার আক্ষেপ, ‘আমায় কেউ ফুলের শুভেচ্ছা কিংবা চকোলেট দিচ্ছে না।’ মাবিয়া ৫ দিন ধরে ওই ঝুপড়ি ঘরে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ তার খোঁজখবর নেয়নি। ইতিমধ্যে পহেলা ফাল্গুন আর বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও পার হয়েছে। একটিবারের জন্যও রাষ্ট্র, সরকার কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ তার ঝুপড়ি ঘরটিতে উঁকি দেননি। শুভেচ্ছা কিংবা অভিনন্দন জানাননি। লাল গোলাপ কিংবা ভালোবাসার কোনো বার্তা নিয়ে তরুণ প্রজন্মের কেউই যায়নি মাবিয়ার কুঁড়েঘরে। স্বর্ণজয়ের পর ফেসবুকে মাবিয়ার সফলতা, স্বর্ণজয়ীতে উল্লাস-আনন্দে ফেটে উঠেছিলেন অনেকেই। কেউ কেউ জোর গলায় বলেছিলেন, মাবিয়া দেশে ফিরলে বড় আকারের সংবর্ধনা দেয়া হবে। ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হবে। কিন্তু সব কথা কথায়ই রয়ে গেল।
৫ দিন ধরে মাবিয়া বাবা-মায়ের সঙ্গে এক প্রকার পানির ওপরে ভাসা ঝুপড়ি ঘরে সময় কাটাচ্ছেন। বাবা-মা আর পার্শ্ববর্তী ঝুপড়ি ঘরের শিশুদের গল্প শোনাচ্ছেন। বিজয়ের গল্প, আনন্দের গল্প। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় বুক ফাটা কান্নার অনুভূতির কথা।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর খিলগাঁও সিপাহীবাগ বাজার সংলগ্ন ছোট্ট একটি ঝিলে দেখা হয় স্বর্ণকন্যা মাবিয়ামের সঙ্গে। প্রায় ৩শ’ গজ বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে মাবিয়াদের থাকা ঝুপড়ি ঘরটিতে পৌঁছতেই কানে ভেসে আসে হা-হুতাশার কথা। জয় আর অভিমানের কথা। নোংরা পানির ওপর ঘেরা ঘরটির ভেতর প্রবেশ করতেই কাঠের তৈরি একটি নড়বড়ে খাটের কোনায় বসা মাবিয়া দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঘরের ভেতর আত্মীয়-স্বজনদের ভিড়। দু’এক কদম নড়াচড়া করতেই মাবিয়া বললেন, ‘ভাইয়া আস্তে আস্তে পা ফেলুন, বাঁশ ভাঙা আছে, ছিদ্র দিয়ে পা খসে যেতে পারে। এই যে ভাইয়া (যুগান্তরের ফটোসাংবাদিক শামীম নূর) আপনিও আস্তে নড়াচড়া করুন। বাঁশের ওপর খাড়া ঘর, বুঝতেই তো পারছেন।’
ওই ঘরে বসেই কথা হয় মাবিয়ার সঙ্গে। লাল-সবুজ পতাকার রঙের জার্সি পরা মাবিয়ার চোখে তখন অশ্র“ টলমল করছিল। আপনি এমন করছেন কেন, মন খারাপ? না ভাইয়া, আপনাদের বসতে দিতে পারছি না, ভয়-আতংক নিয়ে কথা বলছেন, কখন ঘর ভেঙে পড়ে। আপনি দেশে কবে এসেছেন? বৃহস্পতিবার ভোরে। বাস থেকে নামার পর মামা কাজী শাহাদত হোসেনের মোটরসাইকেলে করে বাসায় আসি।
মাবিয়া জানান, যখন তিনি স্বর্ণ জয় করেন তখন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দর্শক, বাংলা ভাষাভাষী দর্শক আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন। স্বর্ণ জয়ের পর থেকেই তিনি আনন্দে গর্বে কাঁদছিলেন। মনে মনে এটাও ভাবছেন, পদক গ্রহণের সময় অন্তত কাঁদবেন না। যখন বাংলাদেশে জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল তখন তিনি ঠিক থাকতে পারেননি। বুক ফেটে কান্না আসে, শরীরের প্রতিটি রক্ত কণায় বেজে উঠছিল জাতীয় সঙ্গীতের সুর। দেশের মানুষের কথা, পতাকার কথা, পরিবারের কথা।
আপনি তো জয়ী হয়ে দেশে ফিরেছেন, এখন কেন চোখের কোনায় পানি টলমল করছে? এখন দুটি কারণে অনেক খারাপ লাগছে। ভাবছিলাম দেশে ফিরলেই দেশের মানুষ আমাকে জড়িয়ে ধরবে। নানারকমের মানুষ ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবে। রাষ্ট্র তথা সরকারের বড় বড় কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিদের কেউ অভিনন্দন জানাবেন। আদর করে বলবেন, তুমি আমাদের অহংকার। হাতে তুলে দেবেন ফুলের তোড়া কিংবা চকোলেট। গৌহাটিতে অনেক মানুষ ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, হাতভরে চকোলেট দিয়েছেন। তখন অনেক ভালো লেগেছিল, যখন নিজের দেশে এসে এমন ভালোবাসা, শুভেচ্ছা পাচ্ছি না তখন খারাপ লাগছে।
আমি তো ভাবছিলাম, মানুষ আমার জন্য লাইন ধরে অপেক্ষা করবে। শুভেচ্ছা জানাবেন, ফুলের তোড়া দেবেন, সেলফি তুলবেন। কই, কিছুই নেই। পহেলা ফাগুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিসবেও কেউ একটি বারের জন্য আমাদের কুঁড়েঘরে চুপি দিয়ে যায়নি। বলতে আসেননি, মাবিয়া কেমন আছ, এই নাও চকোলেট। আস সেলফি তুলি, তুমি আমাদের গর্ব… কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন মাবিয়া আক্তার সিমান্ত।
মাবিয়া আরও জানান, জীবনে কোনো দিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে সামনাসামনি দেখিনি। আমি কেমন বোকা, ভেবে রেখেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে। তিনি আমায় বুকে ছড়িয়ে ধরবেন, আদর করবেন। টেলিভিশনে প্রায় দেখি, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সাধারণ-দরিদ্র মানুষদের বুকে টেনে আদর করেন। সফল মানুষদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। আমায় ধরবেন এমনটা ভেবেছিলাম।
বাবা-মাকে টেনে এনে এই প্রতিবেদকে দেখিয়ে বললেন, ‘দেখেন আমার মা-বাবা, বাবা মুদির দোকানে কাজ করেন, মা গৃহিণী। বাবা কখনোই আমাকে খেলতে দিতেন না। এই মা-ই আমাকে উৎসাহ দিতেন। বাবাকে অনেক লোক চোখে চোখে বলতেন, মেয়েকে খেলাধুলা করাচ্ছেন আপনি তো দুজখে যাবেন। মেয়েদের দিয়ে খেলাধুলা করানো মানেই দুজখের পথের দিকে হাঁটা। আমি খেলা করি, পছন্দ করি এমনটায় সাধারণ মানুষ নানান অপমানজনক কথা বলতেন বাবাকে। এখন কেউ হয়তো আর অপমানজনক কথাবার্তা বাবাকে বলবে না। আমি দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছি, স্বর্ণ জয় করেছি।’ এমনটা বলতেই মা-বাবা আর মাবিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মাবিয়া জানান, দেশ, দেশের পতাকাই মানুষের শক্তি। তিনি সেই শক্তিতেই জয় ছিনিয়ে এনেছেন। দেশের মাটিতে সংবর্ধনা কিংবা ফুলেল শুভেচ্ছা না পেলেও খেলাধুলা কখনও ছাড়বেন না। এ ঘরে থেকেই লড়াই করবেন।
কথার ফাঁকে ঘরগুলো দেখা হয় এ প্রতিবেদকের। ঘরের ভেতর বসার কোনো জায়গা নেই। ঝিলের করুণ চিত্রটাও ভয়াবহ। চারদিক নোংরা। একটা অসহ্য জীবন-যন্ত্রণার জাঁতাকলে তাদের যেন দিন কাটাতে না হয়। বাঁশের এক ফুট চড়া একটি সাঁকো দিয়ে ঝুপড়ি ঘরে ফিরেও শান্তিতে বাতাসের হাওয়াটুকুও পান না। পাবেনই বা কী করে? ঘরে তো বাতাস ঢোকে না। একটা গুমোট অবস্থার মধ্যেই তাদের থাকতে হয়। জন্মের পর থেকেই এই রূঢ় বাস্তবতা। মা আক্তার বানু বলেন, ‘আমার মাবিয়া এখন দেশ-বিদেশে পরিচয় পেয়েছে। তার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। তার জন্য পুষ্টি খাবার, সুস্থ জীবন জরুরি। কিভাবে জোগাড় করব এ খাবার।’
পাশের একটি বাসা থেকে বের হয় বয়স্ক এক ব্যক্তি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষোভ করে বলেন, মেয়েটি দেশের সম্মান বয়ে এনেছে, সে দেশের গর্ব। সে এমন জায়গায় বসবাস করা তো মারাত্মক ঝুঁকির। মাবিয়া যদি দেশের সম্মান বয়ে আনতে পারে, তাহলে তার সম্মানে, তার সুরক্ষায় সরকার কিছুই করবে না?
মাবিয়ার বাবা হারুন-অর রশিদ জানান, ১ ছেলে ২ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট মাবিয়া। ছোটবেলা থেকেই সে খেলাধুলায় মনোযোগী ছিল। খেলতে বের হলেই লোকজন তাকে অনেক বাজে বাজে কথা বলত। মেয়েকে দিয়ে খেলাধুলা করালে দুজখে যেতে হবে। আরও নানান বাজে বাজে কথা বলত মানুষ। এখন আমি আমার মেয়েকে নিয়ে গর্ব করি। কে কি করল, কে কি করল না তা নিয়ে ভাবি না। তবে আমার মেয়েটা অনেক খুশি হতো যদি তাকের কেউ সংবর্ধনা দিত, ফুলের তোড়ায় বরণ করত। প্রধানমন্ত্রী একটিবারের জন্য ফোন দিয়ে আমার মেয়েকে শুভেচ্ছা জানাত।
যখন এই প্রতিবেদন আর ফটোসাংবাদিক তাদের ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর থেকে বের হচ্ছিল, তখন পরিবারের সদস্যরা কাতর কণ্ঠে বলতে লাগল, আপনারা বসেন মিষ্টি খেয়ে যান। দাঁড়ানো অবস্থায় আমাদের মিষ্টি খাওয়ালেন মাবিয়া।